
বাংলাদেশী পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে বড় হুমকির মুখে বাংলাদেশ। এটি কার্যকর হলে চরম সঙ্কটে পড়বে রফতানি খাত। বিশেষ করে তৈরী পোশাক রফতানিতে নিশ্চিতভাবেই ধস নামবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ তার করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দুই দফা আলোচনা করেছে। তাতে সুফল আসেনি। তৃতীয় দফা আলোচনার প্রস্তুতি চলছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক এবং অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক যে বিশ্বের প্রচলিত শুল্কনীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং অন্যায্য সেটি স্পষ্ট। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি আছে এমন সব দেশের ওপর বিপুল হারে পাল্টা শুল্ক বলবৎ করেছে দেশটি। কোনো দেশই তা সহজভাবে নেয়নি। কানাডা প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে পণ্য রফতানি করছে চীন ও ইউরোপের দেশগুলোতে। আমদানিও করছে এসব দেশ থেকেই। আর কানাডার মানুষ মার্কিন পণ্য সম্পূর্ণ বর্জন করেছে। চীনও পাল্টা শুল্ক চাপানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বন্ধ করেছে। নতুন বাজার খুঁজে নিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। ব্রাজিল যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ প্রত্যাখ্যান করে এটিকে ‘অগ্রহণযোগ্য বø্যাকমেইল’ বলে উল্লেখ করেছে। মেক্সিকো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ইউরোপীয় বাণিজ্য কমিশন পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। গুরুতর কথা বলেছেন সিঙ্গাপুরের একজন সিনিয়র মন্ত্রী লি সিয়েং লুং। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, বৈশি^ক বাণিজ্যে ‘ওয়ার্ল্ড মাইনাস আমেরিকা’ হলো বর্তমান সঙ্কট সমাধানের একমাত্র উপায়।
বিশ্বের এসব ঘটনায় বাংলাদেশের করণীয় নির্ধারণের উপাদান পাওয়া সম্ভব। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অবস্থান চীন, কানাডা, ব্রাজিল বা ইইউর মতো নয়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সামর্থ্য বিবেচনায় রেখে। আমরা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারব না, পরাশক্তিকে রুষ্ট করে সামনে এগোনোর প্রশ্নই আসে না; রাতারাতি নতুন বাজার খুঁজে নেয়াও কঠিন।
বাংলাদেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ আছে। এটি হলো- চীনের সাথে দূরত্ব রাখার সতর্ক বার্তা। আমাদের অর্থনীতির অনেক খাত চীননির্ভর। তাই চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক রহিত করা হবে অর্থনীতির শিরদাঁড়া ভাঙার শামিল।
দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আলোচনা করে শুল্ক কমানোর সম্ভাবনা সামান্যই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শর্ত মেনে নেয়া অসম্ভব। শুল্কহার মেনে নিয়েই আগামীর পরিকল্পনা করতে হবে। বিকল্প রফতানি বাজার খুঁজতে হবে এবং তৈরী পোশাক ছাড়াও অন্যান্য পণ্য রফতানির ওপর জোর দিতে হবে।
তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাজার প্রসারের চেষ্টার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও জাপানসহ এশিয়ার দেশগুলোতে বাজার সম্প্রসারণের তাগিদ দেন। সন্দেহ নেই আগামী দুই আড়াই দশকের মধ্যে বিশ্বের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হবে এশিয়া।
মনে রাখতে হবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্কনীতি কেবল বাংলাদেশকে নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই গভীর সঙ্কটে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে যৌথভাবে সমাধানের উপায় খোঁজার সুযোগ আছে। ব্রিকসের মতো নতুন বৈশ্বিক জোট এবং আসিয়ান বা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক জোটভুক্ত দেশগুলোর সাথেও আলোচনা চলতে পারে। একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে শুল্ক কার্যকর করা হয়তো সম্ভব হবে না। ট্রাম্পের শুল্কনীতির ফলে এরই মধ্যে দেশটির অর্থনীতি বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েছে।