যানবাহনে হয়রানির শিকার নারীরা

  • মুনিয়া মুন
  •  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৬, আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৯

রাজধানীতে গণপরিবহনে বা বাসে চলাচল করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নারীদের। নারীদের জন্য নির্ধারিত বাসের সংখ্যা যেমন সীমিত, তেমনি সাধারণ বাসে তাদের জন্য খুবই কমসংখ্যক আসন বরাদ্দ থাকে। ফলে নারীদের বাসে চলাচল করা কঠিন।

সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির কর্মকর্তারাই বলছেন, শুধু নারীদের জন্য ঢাকায় ও চট্টগ্রামে মাত্র অল্প কিছু বাস চালু করা হয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে সরেজমিন দেখা যায়, নিয়মানুযায়ী বড় বাসে নয়টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক হলেও তা কেউ মানছে না। এ কারণে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। কিছু বাসে ‘মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন’ লেখা থাকলেও অনেক বাসে এ লেখা দেখা যায়নি।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাসে ওঠার চেষ্টা করছিলেন এক নারী। মিরপুর থেকে একেকটি বাস আসে, আর ওই নারী হাত তুলে সেটিকে দাঁড়ানোর সঙ্কেত দেন, কিন্তু বাস আর থামে না। কয়েকটি বাস থামলেও সেগুলোতে এত বেশি যাত্রী যে, ওই নারী চেষ্টা করেও উঠতে পারননি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে ওঠেন।

এ রকম চিত্র রাজধানীর প্রায় প্রতিটি রাস্তায়। নারী ও যাত্রীকল্যাণ নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, প্রতিদিনই কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সে তুলনায় নারীর জন্য বাস একেবারেই নগণ্য। এগুলো চোখেও পড়ে কম। এ ছাড়া এই বাসগুলো সকালে ও বিকালে চলে। তাই এর সুবিধা খুব কম নারীই পান। দেশের সব জায়গায় দিন দিন বাড়ছে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা। সে তুলনায় তাদের জন্য গণপরিবহনের বরাদ্দ এতই কম যে তা না থাকারই শামিল। বাসে অফিসে যাওয়া-আসার সময় যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। চালকের সহকারীরা সে সময় নারীদের বাসে উঠতে দিতে চান না। ওঠানামা করার সময় গায়ে হাত দেন। খারাপ ব্যবহার করেন। তার পরেও ধাক্কাধাক্কি করে ওঠার পরে পুরুষ সহযাত্রীরাও নানা রকম হয়রানি করে থাকেন। কেবল যাতায়াতে ভোগান্তির কারণে অনেক কর্মজীবী নারী চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন বলেও জানা যায়।

নারীদের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করা হলে তাদের এসব ভোগান্তি-হয়রানি কমাতে পারে বলে মনে করেন কর্মজীবী অনেক নারী। পাশাপাশি এতে নারীরা চাকরি করতে আরো উৎসাহিত হবেন। একই বাসে নারীদের জন্য পৃথক আসন বাড়ানোরও দাবি জানান তারা। কর্মক্ষেত্রে বর্তমান যুগে নারীর পদচারণা আগের তুলনায় বেড়েছে বহুগুণ। তবুও যাত্রাপথে নারীদের বিড়ম্বনা কমেনি এতটুকু। বরং বেড়েছে। অনেকে আবার অভিযোগ করেন, বাসের হেলপার, কন্ডাক্টর ও ড্রাইভার সুযোগ পেলেই নারীদের সাথে অশালীন আচরণ করে।

নারীদের নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন বিভিন্ন যানবাহনে যাতায়াত করতে হয়। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কির মধ্যে তাদের হয়রানি ও অসম্মান করার ঘটনা কারোরই অজানা নয়।

প্রতিটি বাসে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৫ থেকে ৬টি সিট। কাউন্টার বাসের ক্ষেত্রে সামনের তিন সারি শিশু, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে। তিন সারিতে ৯ জন বসতে পারে। বাকি আসন পুরুষের জন্য রাখা হয়েছে। এখানেও নারীরা বৈষম্যের শিকার। লোকাল বাসের ৫-৬টি সিট পূর্ণ হলে নারীযাত্রীদের বাসে উঠতে দেওয়া হয় না। সিট নেই বলে চিৎকার করতে করতে হেলপাররা ধাক্কা দিয়ে গেট থেকে মেয়েদের সরিয়ে দেয়। এর পরও যদি জোর করে কোনো মেয়ে বাসে উঠে পড়েন পুরুষ যাত্রীদের মাঝখানে অবস্থান করে তার যে শিক্ষা হয়, তাতে দ্বিতীয়বার এভাবে বাসের যাত্রী হয়ে পুরুষদের মাঝে দাঁড়ানোর চিন্তাও করবেন না। নারীযাত্রী হয়রানির এই চিত্র ঢাকা শহরে যেমন দেখা যায় তেমনি ঢাকার বাইরেও দেখা যায়।

শহরে যেসব বাস চলাচল করে সেসব বাসে সামনের দিকের নয়টি সিট নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত থাকলেও পিক আওয়ারে সেই নয়টি আসনে বসতে পারা তো দূরে থাক প্রায়ই সময় নারীযাত্রীরা বাসে উঠতে পারেন না। আবার কোনোভাবে বাসে উঠতে পারলেও সেসব আসনে বসতে পারেন না। প্রায় সময়ই এসব আসনে আগে থেকেই বসে থাকেন পুরুষ যাত্রীরা। তাদের উঠতে বললে কেউ কেউ আসন ছেড়ে দিলেও অনেকে আবার বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার ৫০ শতাংশ মহাসড়কে, ২৫ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে ও ২৫ শতাংশ রাজধানীর অভ্যন্তরীণ সড়কে ঘটে। মাঝারি পাল্লার বাসে ঘটে ২৫ শতাংশ, আন্তঃশহর বাসে ৩০ শতাংশ, স্বল্প দূরত্বের বাসে ২০ শতাংশ এবং দূরপাল্লার সিটিং বাসে ১৫ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

অধিকাংশ ঘটনার সাথে পরিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার জড়িত, যাদের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী টহল পুলিশ কম, এমন সব জায়গাতেই নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে। তাই অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।