একটা বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদ হলো, ‘খালি কলসি বাজে বেশি।’ এই প্রবাদ বাক্যের অনেক ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। যেমন- সক্ষমতা না থাকলেও বাগাড়ম্বরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। মেধা, বোধ বিবেচনার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সবজান্তার ভান করা এবং উচ্চবাচ্য করা। সেটা নিয়ে উল্লম্ফন করা। এক কথায় বললে, অসারের তর্জন গর্জন সার। বিজ্ঞজনদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ যতটা দুর্বল, অক্ষম ঠিক ততই বেশি তারা বাগাড়ম্বর করতে অভ্যস্ত। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কথার ফুলঝুরি ছড়ান তারা। এরই অংশ হিসাবে বহুক্ষেত্রে এ ধরনের কর্তৃপক্ষ বেশুমার প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার করে বসে যা তারা বাস্তবে রূপ দেয়ার যোগ্যতা রাখে না। এসব কেবল বলার জন্য বলা। ক্ষণিকের জন্য মানুষকে আশার মোহে ভুলিয়ে রাখাই এর লক্ষ্য।
মোটা দাগে বলা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এখন ওই রকম একটা বদ্ধ বলয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। সেই কর্তৃপক্ষ এখন যা কিছু বলছে, সেটা অন্তঃসারশূন্য। জনমানুষের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ যখন যা বলছে তার অধিকাংশই বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। তাতে সত্যতার লেশমাত্র নেই। তাদের কথাবার্তায় রয়েছে অহমিকা। মানুষের প্রতি প্রশাসনের ধারণা যেন এমনই যে, সাধারণ মানুষ এখনো সাবালক হয়ে ওঠেনি। বোধ বিবেচনায় মানুষ পরিপক্বতা অর্জন করতে পারেনি। বরং তারা যা কিছুই বলেন সেইটাই একমাত্র সত্য ও চিরন্তন। শিশুদের প্রবোধ দিয়ে ভুলিয়ে রাখার মতো। তাহলে মানুষের অভাব-অভিযোগ দুঃখ-কষ্ট থাকছে কেন।
সত্য হলো, এই জনপদের পোড় খাওয়া মানুষ মনে করে, তাদের সাথে নিছক প্রবঞ্চনা করা হচ্ছে। ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ প্রতিমুহূর্তে যা বলে তার প্রতিটি বাক্য অন্তঃসারশূন্য। বর্তমানে দেশের মানুষের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যখন যা বলে তা থেকে এই ধারণাই তৈরি হচ্ছে। তাদের সব বার্তা বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তারা মনে করেন, দেশের মানুষ এখনো সাবালকত্ব লাভ করেনি। তাদের বোধ এখনো সৃষ্টি হয়নি। তাই যা কিছু কর্তৃপক্ষ বলে তাতে প্রত্যয় জন্মেনি। শিশুদের যেমন সহজেই প্রবোদ দেয়া যায়, এখানেও জনগণকে সেভাবে প্রবোধ দিয়ে ভুলিয়ে রাখা যাবে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, খোদ এই কর্তৃপক্ষেরই এখনো বয়োসন্ধি পার হয়নি। সে জন্য এমন উদ্ভট ধারণা লালন করছে। আসলে দেশের ক্ষমতায় থাকা কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালনের নানা উদাহরণ দিয়ে ইতোমধ্যে এটাই প্রমাণ করেছে যে, তারা অক্ষম অযোগ্য। তাদের এই দুর্বলতা থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখতেই তাদের যত বাগাড়ম্বর। আর অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু তার পরও তাদের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে বেশুমার প্রতিশ্রুতি আর করা হচ্ছে শত অঙ্গীকার।
এমন ভঙ্গুর অবস্থার ভেতর অবস্থান করার পরও ক্ষমতায় থাকার অপরিসীম বাসনা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে। সে জন্য যত অপকৌশল প্রশাসনের। আবারো আগের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চাই। সরকার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। অনেক অঙ্গীকার ও উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো উদ্যোগ কিংবা কোনো পদক্ষেপ কেউ-ই লক্ষ্য করেনি। এ দিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের জীবন ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সরকারিভাবেই এখন বলা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য নাকি ১০ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে।
অথচ অর্থনীতি এবং দ্রব্যমূল্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এমন সব অর্থনীতিবিদদের ধারণা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশের মতো হয়েছে। এ দিকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফপি) সম্প্রতি বাংলাদেশের খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, খানা জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনা বাবদ খরচ ছিল প্রতি মাসে এক হাজার ৮৫১ টাকা। গত দুই বছরে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মাথাপিছু খাবার কেনা বাবদ খরচ বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৯২৩ টাকা; যা দুই বছর আগের চেয়ে ৫২ শতাংশ বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, গত দুই বছরে কি মানুষের রোজগার ৫০ শতাংশ বেড়েছে? এর ছোট উত্তর হচ্ছে, না। নিকট অতীতে ক্ষমতাসীন সরকারের তদানিন্তন বাণিজ্যমন্ত্রী দফায় দফায় অঙ্গীকার করেছিলেন, অবশ্যই দ্রব্যমূল্য কমানোর জরুরি উদ্যোগ নেয়া হবে। তারপর দিন গেল, মাস শেষে মন্ত্রীও বিদায় নিলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ে তার দম্ভোক্তি হাওয়া মিলিয়ে যায়। বিদায় নেয়ার আগে বাণিজ্যমন্ত্রী একজন পরাজিত সেনা নায়কের মতো বললেন, সিন্ডিকেটের জন্য কিছু করা গেল না
মন্ত্রী বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না। সরকারের চেয়েও নাকি সিন্ডিকেট শক্তিশালী। এটা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার ও সেই দুষ্ট চক্র সিন্ডিকেটের অবস্থান পরস্পরের খুব সন্নিকটে প্রায় সমান্তরাল। বলতে হবে, উভয়ের সহাবস্থান এক দিনের নয়, বহু দিন থেকে একই বিন্দুতে। সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করা কিছুমাত্র বিস্ময়কর নয় বা বিচিত্রও নয়। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী তারাই যারা সরকারকে উঠাতে নামাতে পারে। এখন পরিস্থিতি সেই সমীকরণে পৌঁছে গেছে। যারা সরকারকে বসাতে সরাতে পারেন, তাদেরই ক্ষমতাসীনদের কুর্নিশ করতে হবে। আগের সংস্কৃতি এটাই ছিল যে, জনগণই সরকারকে উঠাতে বসাতে সক্ষম ছিল।
এখন আর সেটা নেই। জনগণকে হটিয়ে সে স্থান দখল করেছে সিন্ডিকেট। এখন ক্ষমতায় থাকার জন্য সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করছে দেশের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। এখন মন্ত্রী মহোদয় যে সিন্ডিকেটের কথা বললেন, তা নিয়ে গোটা সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি। মৌনতাই কিন্তু সম্মতির লক্ষণ। যাই হোক, গত জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। অথচ ইত্যবসরে দ্রব্যমূল্য আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এরপর কারো কোনো কথা নেই। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, খাবারের পেছনে দরিদ্র মানুষের ব্যয় বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। ২০২২ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের মাসিক খাবার কেনার মাথাপিছু খরচ এক হাজার ৮৫১ টাকা। এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে তিন হাজার টাকা। একটা মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম যে খাবার গ্রহণ করে, সেখানে ব্যয় কমানো হয়েছে ৬৮ শতাংশ, যেসব মানুষ বাকিতে খান তাদের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ। মানুষ তার চিকিৎসা খরচ কমিয়েছে ২২ শতাংশ। এখন সঞ্চয় ভেঙে চলেন ১৩ শতাংশ মানুষ। এসব গবেষণালব্ধ তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউশন ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কাছ থেকে।
দ্রব্যমূল্য কমানো নিয়ে সর্বশেষ কথা মাত্র ক’দিন আগে বলেছেন অর্থমন্ত্রী বাজেট-উত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে। তার বক্তব্য অনেকটা যেন, ‘আর ক’টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’র মতো। হেয়ালি রেখে তার সঠিক উত্তরটা কী ছিল জানা যাক। তিনি উষ্ণ শুষ্ক মুখে বলেছিলেন, আর ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। গত মাস নয়, বহু মাসও নয়। অনেক ক’টি বছর থেকে মানুষ চরমভাবে ভুগছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। অর্থমন্ত্রীর ছয় মাস কয় বছরে শেষ হবে- সেটা তো ভবিতব্য। ততদিনে এই ধরাধামে কে থাকবে, কে থাকবে না, তা-ও কারো জানা নেই।
ওপরে আরো বলা হয়েছে যে, সরকার ইতোমধ্যে বেশুমার ওয়াদা অঙ্গীকার করেছে। এমন অঙ্গীকার মাঠে ময়দানে হাস্যোচ্ছলে করা হয়নি। বরং দলিল দস্তাবেজে সেই অঙ্গীকারগুলো লিপিবদ্ধ আছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের যে ‘নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের প্রকাশিত ইশতেহারে দলটির যত সব অঙ্গীকার সন্নিবেশিত রয়েছে।
তার সবগুলো নিয়ে নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা যেতে পারে। সুশাসন : এই শিরোনামে যেসব বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ তথা শাসকদল জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিল, সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ কোনো আলোচনা বিশ্লেষণ নয়। কেবলমাত্র স্পর্শ করা হবে। (ক) গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ। এটাই নাকি সরকারি দল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মোটা দাগে এ সম্পর্কে কথা বলতে সবারই সঙ্কোচ বোধ হয় হতে পারে। কেননা সরকারি দল গণতন্ত্র আর ভোট ব্যবস্থাকে এখন এক অন্ধ গহ্বরের কাছে নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে! এর পরও কোন মুখে ক্ষমতাসীনরা গণতন্ত্র আর নির্বাচন নিয়ে কথা বলে। সেটা ভেবে মানুষ বিস্ময়ে বিমূঢ়। ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দলটি অবদান রাখবে। প্রথম কথা হচ্ছে, কোন আইনের শাসন! এখন কি দেশে আইন বলতে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব আছে। শাসক দলের অভিপ্রায়ই এখন আইন।
সে অভিপ্রায় কার্যকর বা প্রয়োগ করতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলীয় কমান্ডের অধীনে সদা তৎপর। মানবাধিকার, সেটা তো কবে কোন বনে এখন বনবাসে রয়েছে, তার কোনো হদিসই নেই। জবাবদিহির বিষয় নিয়ে ইশতেহারে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জবাবদিহি কোন প্রতিষ্ঠান করবে? আগের সংস্কৃতি ছিল, জাতীয় সংসদের কাছে সরকারসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি করতে হতো। এখন সংসদে কোনো বিভাজন নেই। সবার একদল, এক আত্মা, এক অভিপ্রায়, এক লক্ষ্য। তাই বলতে হয় কে কার জবাবদিহি করবে। বস্তুত কে কার অলঙ্কার হয়ে ‘শোভা’ বর্ধন করছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি সেখানে সন্নিবেশিত রয়েছে।
সেটি হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ। বাংলাদেশে এই জিরো টলারেন্স হচ্ছে, শূন্যের ডানে যদি আরো হাজারটা শূন্য বসানো হয়, তবে তার যোগফল সেই শূন্য হবে। যদি বায়ে কোনো অঙ্ক লেখা হয়। তবেই সেটা অর্থবোধক হতে পারে। কিন্তু শাসক কেবল ডানেই হাজারটা শূন্য বসিয়ে চলেছে। তার যোগফল শুধু শূন্য নয় বরং আরো একটা ইকোয়েশন আছে। সেটা হলো সমান সমান বেনজীর আর আজিজ। এই লেখা শেষ করতে চাই আর একটি শ্লোক যোগ করে। সেটা হলো, যত গর্জে তত বর্ষে না। এই জনপদের মানুষ গর্জন শুনে এখন চাতকের মতো আকাশের দিকে চোখ মেলে আছে। কিন্তু তার চোখে মুখে এক ফোঁটা বারিবিন্দু ঝরছে। কথায় কখনো চিঁড়া ভিজে না। চিঁড়া ভিজাতে পানির দরকার। সে পানি কোথায়।
Nayadiganta