লেখক ও সাংবাদিক
কিংবদন্তির ভানুমতী জাদুর খেলা জানতেন, সেখান থেকেই ‘ভানুমতীর খেল’ কথাটার জন্ম। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও খেলা জানেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির রাজজুটি নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর ‘বঙ্গ বিজয়’ তিনি ঠেকিয়ে দিয়ে ছিলেন ‘খেলা হবে’ আওয়াজ দিয়ে। বিধানসভা নির্বাচনের বিশাল সেই বিজয় দিয়ে সে খেলার উপসংহার টেনেছিলেন তিনি। এখন খেলার দৌড়ের অভিমুখ ঘুরে গেছে। মমতার নজর এখন দিল্লির দিকে।
মমতার টি-টোয়েন্টি ‘খেলা হবে’
নির্বাচনী রাজনীতির জয়-পরাজয় টেস্ট ম্যাচের মতো লম্বা লড়াইয়ের ব্যাপার। সেখানে তৃণমূল খেলছে টি-টোয়েন্টি কায়দায়। ধুপধাপ প্রতিপক্ষের উইকেট ফেলে দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও তৃণমূল হঠাৎ ছন্নছাড়া অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। তৃণমূলের বড় নেতারা নির্বাচনের আগে হঠাৎ বিজেপিতে যোগ দিতে শুরু করলেন। ঘরের সেই ভাঙন মমতা তো সামলেছেনই, এখন ভাঙছেন অন্যের ঘর। পশ্চিম বাংলায় দলে দলে বিজেপি নেতা-কর্মীরা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। ভারতের গোয়া, হরিয়ানা, বিহার, আসাম, উত্তর প্রদেশের পর মেঘালয়ের কংগ্রেসে ভাঙন ধরিয়েছেন মমতা।
অল্প সময়ে কাজ করে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় উঠে এসেছে তৃণমূল। ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িকতার রক্তাক্ত খেলা ও সন্ত্রাস-কারচুপি করেও তৃণমূলের বিস্তার ঠেকাতে পারেনি বিজেপি। তৃণমূলের দাবি, মাত্র তিন মাস কাজ করেই তারা ২৪ শতাংশ ভোট হাসিল করতে পেরেছে। মেঘালয়ের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমার নেতৃত্বে ১২ জন কংগ্রেস বিধায়ক যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য ত্রিপুরা জয়ও ভারতীয় বাঙালিদের প্রধান দলের জন্য এখন একটা বাস্তব সম্ভাবনা।
ভারতের লোকসভার নির্বাচন ২০২৪ সালে। সেই নির্বাচনে তৃণমূলকে আরও ওপরে তুলতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আঞ্চলিক দল থেকে জাতীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হচ্ছে তৃণমূল। এ অর্জন আসলেই ‘খেলা’র অবদান। খেলাটা অত স্বচ্ছও নয়। তৃণমূল ভাঙছে কংগ্রেসের ঘর। কারা এসেছেন তৃণমূলে? উত্তর হলো আসাম কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় নেতা সুস্মিতা দেব, হরিয়ানা কংগ্রেসের সাবেক প্রধান অশোক তানওয়ার, উত্তর প্রদেশ কংগ্রেসের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ললিতেশ পাতি ত্রিপাঠী, জনতা দলের সাবেক নেতা পবন ভার্মা প্রমুখ।
নেতারা আসছেন মানে ভোটও আসছে, তহবিলও ভারী হচ্ছে। বিজেপিকে মোকাবিলায় ভোটের পাশাপাশি টাকাও যে জরুরি। কংগ্রেসকে দুর্বল করে বিজেপিকে কাবু করা কি সম্ভব? কংগ্রেস এখনো সর্বভারতীয় দল। বিজেপিবিরোধী জোটে কংগ্রেসই যদি না থাকে, সেই জোট কি অর্থবহ হবে?
মোদির বিরুদ্ধে পাল্টা ‘মুখের’ প্রতিযোগিতা
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রধান সমস্যা হলো তার প্রধান নেতা। জাতীয় নির্বাচনে উপমহাদেশীয় ভোটাররা কেবল দল বা মার্কা দেখেই ভোট দেন না, নেতার মুখ দেখেও ভোট দেন। কংগ্রেসের সমস্যাটা সেখানেই। শত চেষ্টা করেও রাহুল গান্ধীকে তারা মোদির মুখের প্রতিমুখ বানাতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তির সামনে রাহুল অনেকটাই পানসে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সেই পাল্টা মুখ হয়ে উঠতে চান পশ্চিম বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা ঘোষণা দিয়েছেন, দুই মাস পরপর তিনি দিল্লি আসবেন। বসবেন বিরোধী নেতাদের সঙ্গে। এর আগে জুলাই মাসে বিরোধীদের ঐক্য আলোচনা হয়। সেই আলোচনা ছিল মমতার ভাষায় ‘সফল’। ভারতের আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে মমতার খায়খাতির বাড়ছে। অস্তিত্বের খাতিরেই আঞ্চলিক ও ছোট দলগুলোকে এক মঞ্চে আসতেই হবে। কিন্তু কংগ্রেসের অস্তিত্ব ধরেই যখন টান দিচ্ছে তৃণমূল, তখন এ অপমান ও অন্তর্ঘাত কি মেনে নেবে কংগ্রেস? মানছে না। কংগ্রেস নেতারা মমতা ও তৃণমূলবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। এই নভেম্বরে দিল্লিতে গিয়ে কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেননি মমতা।
আগামী দুই বছরে বিজেপি যদি তার জনপ্রিয়তা উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে মমতাকেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বিরোধীদের। তবে তার জন্য তৃণমূলকে বিজেপির চেয়ে বেশি আসন না হলেও কংগ্রেসের চেয়ে বেশি আসন পেতে হবে। এককভাবে না হলেও জোটসঙ্গী অন্য দলগুলোর সমর্থন নিয়ে জোটের ভেতর প্রাধান্য পেতে হবে তৃণমূলকে। সেটা অসম্ভব নয়।
মমতা যেখানে এগিয়ে, সেখানে কংগ্রেস পিছিয়ে। ২০২১ সালে বিজেপিকে পরাজয়ের স্বাদ দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁরও রয়েছে দীর্ঘ প্রাদেশিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সাফল্য। দিল্লি গণমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। আঞ্চলিক দলগুলোও কংগ্রেসের চেয়ে তৃণমূলকেই কাছাকাছি ভাববে। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য বিরোধী জোটের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন বাংলার মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদির বিরুদ্ধে এমন শক্তপোক্ত মুখ তো আর দেখা যাচ্ছে না।
আগামী দুই বছরে বিজেপি যদি তার জনপ্রিয়তা উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে মমতাকেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বিরোধীদের। তবে তার জন্য তৃণমূলকে বিজেপির চেয়ে বেশি আসন না হলেও কংগ্রেসের চেয়ে বেশি আসন পেতে হবে। এককভাবে না হলেও জোটসঙ্গী অন্য দলগুলোর সমর্থন নিয়ে জোটের ভেতর প্রাধান্য পেতে হবে তৃণমূলকে। সেটা অসম্ভব নয়। কারণ, মমতাকে মেনে নেওয়ার চেয়ে বিজেপির ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসসহ সবার জন্যই বেশি ক্ষতিকর। যে মমতা জ্যোতি বসুর মতো বিরাট নেতাকে হারিয়েছেন (যদিও প্রাদেশিক এবং তিনি যদিও তখন মুখ্যমন্ত্রী নন, তবু প্রতীকীভাবে তৃণমূলের কাছে বামফ্রন্টের পরাজয় জ্যোতি বসুর পরাজয় হিসেবেই গণ্য হয়), মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানো তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক।
আঞ্চলিক নেত্রী থেকে জাতীয় মঞ্চে
এ থেকে মমতার কাজের ধরনটা বোঝা যায়। তিনি আক্রমণাত্মক খেলতেই পছন্দ করেন। তা দিয়ে ভোটারদের মনে আস্থার ভাব জাগান। নিজের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগটা তিনি সরাসরি রাখতেই পছন্দ করেন। মাঝখানে কোনো মধ্যস্থতাকারী যদি থাকেও, তাদের অবস্থান অপসারণযোগ্য। এভাবে নিজেকে অনিবার্য করে তোলেন তিনি, তখন সপক্ষ বা বিপক্ষ—কারও পক্ষেই তাঁকে অস্বীকার করা সম্ভব হয় না। পশ্চিমবঙ্গের লাগাম হাতে রেখে, ত্রিপুরা-আসাম-মেঘালয়কে পাশে রেখে হরিয়ানা-গোয়া-বিহার-উত্তর প্রদেশে প্রভাব বাড়াতে চান তিনি। যদি দলছুট নেতাদের নিয়ে সেটা সম্ভব হয়, তাহলে বিরোধীদের প্রধান মুখ হয়ে উঠতে অসুবিধা হবে না এই মুখ্যমন্ত্রীর। কংগ্রেসের দুর্বলতাই হয়ে উঠেছে তাঁর সফলতা। কংগ্রেসের যে নেতারা আদর্শিক কারণে বিজেপিতে যোগ দিতে চান না, তৃণমূল হয়েছে তাঁদের সুবিধাজনক গন্তব্য।
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, কংগ্রেস নয়, বিজেপিকে ঠেকাচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলো। তৃণমূলের আঞ্চলিক পরিচয়ও ফলদায়ক হয়েছে। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক স্লোগান চলবে না, আক্রমণাত্মক ‘খেলা হবে’ ডাকও সেখানে হিতে বিপরীত হতে পারে।
এটাও মনে রাখা দরকার, কংগ্রেস দুর্বল হলেও এখনো বড় শক্তি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা ১০ শতাংশ আসন পেলেও ভোট পেয়েছে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় ভাটা নামা, বিজেপির প্রাদেশিক নেতাদের তীব্র সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী ভূমিকা, অর্থনৈতিক অবনতি ঠেকানো ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতায় কংগ্রেসের ভোট আরও বাড়ার কথা। কেরালা ও পাঞ্জাবে কংগ্রেসের সম্ভাবনাও বেশি। সুতরাং ২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় জোট গড়ার বেলায় কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করার সুযোগ থাকবে না।
মোদি থেকে মমতা!
পশ্চিম বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক কলিম খানের আলোচিত একটি বইয়ের নাম ‘জ্যোতি থেকে মমতা’। ২০০০ সালের দিকে বইটাকে ভাবা হচ্ছিল জ্যোতি বসুর বামফ্রন্ট যুগের অবসানের ইঙ্গিত হিসেবে। বইটার উপশিরোনাম ছিল ইংরেজিতে, ‘ফ্রম এনলাইটেনমেন্ট টু ইমোশনাল বন্ডেজ’ অর্থাৎ আলোকায়ন থেকে মমতার বন্ধনের দিকে। আবেগে ও মমতা বামফ্রন্টেরও কম ছিল না। কিন্তু শেষ দিকে নন্দীগ্রামে কৃষক হত্যার পরের ভূমিকা দিয়ে মমতা হয়ে ওঠেন আবেগীয় বন্ধনের প্রতীক। ভারতের জনগণ এখন বলশালী মোদিমত্ততার বদলে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কল্যাণ ও মমতা পেতে চায়। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের বিজয় সেই চাওয়া দাগিয়ে দিয়েছে। মমতা খুঁজছে সেখানকার মুসলমান ও দলিত মানুষও। মমতা কখনো প্রধানমন্ত্রী হোন বা না হোন, চেতনার দিক দিয়ে মোদি থেকে মমতার দিকেই মোড় ঘুরছে রাজনীতি।
মমতার দিল্লি অভিযান আরেকটা পরিবর্তনেরও প্রমাণ। প্রখ্যাত বাঙালি লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আক্ষেপ ছিল, বাঙালি নেতারা উত্তর ভারত তথা দিল্লির সঙ্গে পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক পত্নীর মতো। আত্মাভিমানে আঘাত লাগা মাত্রই বাঙালি গোসাঘরে একা বসে থেকেছে। সুভাষ বসুর সময় থেকেই নাকি এমনটা হয়ে আসছে। বাঙালির উগ্র জাতীয়তার কারণেই নাকি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তারা উপেক্ষণীয়। এমনকি সর্বশেষ জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে বিরত রাখার কমিউনিস্ট সিদ্ধান্তও পশ্চিম বাংলার বিপক্ষে গেছে। কোনো বাঙালি কখনো দিল্লিতে শাসকের আসনে বসতে পারেননি।
মমতা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথামতো উত্তর ভারতের প্রাধান্য মেনে দিল্লিতে জায়গা খুঁজছেন না। বাঙালি হিসেবেই তিনি সর্বভারতীয় নেতা হতে চাইছেন। তিনি নিয়েছেন মধ্যপথ, বাংলায় জাতীয়তাবাদ কিন্তু ভারতীয় স্তরে সমাজকল্যাণের আহ্বান। এ যাত্রায় তিনি যদি সফল না-ও হন, তার পরও বাঙালির জন্য দিল্লির দরজা প্রশস্ত করার অবদানটা তাঁকে দিতে হবে।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক। [email protected]