- রিন্টু আনোয়ার
- ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৫৭
‘স্মার্ট’কে মেরামত করতে হয় না। আবার মেরামতকৃত জিনিস ত্রুটি শুধরে ‘স্মার্ট’ হয়ে যায়। কিন্তু রাজনীতিতে স্মার্ট আর মেরামত নির্ধারণ বড় কঠিন। আপেক্ষিকও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্মার্ট আর মেরামত শব্দ দু’টির হালে ভীষণ প্রয়োগ চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে স্মার্ট করে তুলতে চায়। আর বিএনপি চায় বাংলাদেশকে মেরামত করতে। তাদের সেই মেরামতটি কেমন হবে- এর ২৭ দফা রূপরেখা দিয়েছে। তারা একটি রেইনবো ন্যাশন গঠনের কথা বলছে।
ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশকে ইংরেজিতে স্মার্ট বাংলায় পরিপাটি করতে চায়। সেই পরিপাটির ধারণাটি স্পষ্ট নয়। কোন জায়গায়- চেহারায় না অন্তরে, ভেতরে না বাইরে- কোথায় পরিপাটি করবে? নির্বাচন, সুশাসন, দুর্নীতি দমন কোথায়? নাকি রাষ্ট্রের পুরো কাঠামোতে? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানটিতে কিন্তু স্মার্ট ভাব কম ছিল না। তা নেতাকর্মীদের পোশাক-আসাক এমন কি মঞ্চেও। ওই মঞ্চে বক্তৃতার সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আবৃত্তিভরা কণ্ঠে স্মার্ট শব্দ উচ্চারণের মুহূর্তেই ঘটল বিপত্তি। ভেঙে কাত হয়ে পড়ে আস্ত মঞ্চটি। মঞ্চেটি আর মেরামতেরও অবস্থা থাকেনি। তাৎক্ষণিক বলা হয়েছে, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক ওঠায় মঞ্চের এ অবস্থা হয়েছে। মঞ্চ স্মার্টই ছিল।
সরকারি মহলের স্মার্টনেসের এ অবস্থার মধ্যে বিএনপির মেরামত কাজের নমুনাও আছে। অন্তত ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় এর তরতাজা উদাহরণ চলছে। তাদের ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ যে ২৭ দফা রূপরেখা প্রকাশ করেছে এর ৭ নম্বরে আছে- সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা আছে সেখানে। একই সাথে ‘ফ্লোর ক্রসিং’ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার প্রতিবন্ধক ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে পরোক্ষ ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। শুনতে তো চমৎকার। সংসদে দলীয় এমপিদের পদত্যাগ করা না করার ব্যাপারে কি তারা সেই স্বাধীনতা চর্চা করেছিল? বলেছিল কেউ চাইলে পদত্যাগ করতে পারে, নাও পারে। নাকি এক হুকুমে সবাই পদত্যাগ করেছেন?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া দলীয় সিদ্ধান্তে পদত্যাগের পর উপনির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। এটি তার ’স্বাধীন মতের পক্ষে স্বাধীন অবস্থান’। সেই হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তিনি। কিন্তু বিএনপি তার স্বাধীন মত ও মতের পক্ষে অবস্থানকে কতটুকু সম্মান দেখিয়েছে? দল কেন্দ্র থেকে তাকে বহিষ্কার করেছে। যতটুকু জানা যাচ্ছে স্থানীয় বিএনপি তাকে নিজ এলাকায় করেছে অবাঞ্ছিত। এটি কি তারা দলীয় উচ্চমহলের নির্দেশে করেছে? যদি উচ্চমহলের নির্দেশে করে থাকে তাহলে তাদের প্রস্তাবিত রাষ্ট্র মেরামত কাঠামোর সাথে এটি সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। অন্যদিকে স্থানীয় নেতার উৎসাহী হয়ে এমনটা করলে, উচ্চমহল থেকে এ ব্যাপার নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করা দরকার।
নেতৃত্ব এবং দল ‘স্মার্ট’ না হলে কর্মীরা স্মার্ট হবে না। মঞ্চ টেকসই হওয়া তো আরো পরের ব্যাপার। মাত্র কয়দিন আগেই পালিত হলো সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়, যা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করে এসে এখন ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করে, বিজয়ী হয়ে আত্মশাসনের জন্য যে অধিকার পেয়েছিল, যে সংবিধান রচনা করেছিল, তার আলোকে অতি অল্প শতাংশ নাগরিক হতে পেরেছেন আর বাকি বড় অংশই আসলে সব কিছু থেকে বঞ্চিত থেকে আনস্মার্টই থাকছে। দেশের বহুদলীয় ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বহুস্বরের মুক্ত পরিসর কোথায় আছে ? কোনটার কাঠামো ঠিক আছে? কোনটার মেরামত জরুরি নয়?
দেশের রাজনীতির কাঠামো বড় ঠুনকা। বিদ্বেষ-বিভাজন স্পষ্ট। মৌলিক জাতীয় ইস্যুগুলোতে কোনো ঐক্য নেই এবং যাদের ভ‚মিকার কারণে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি তারা যখন নতুন করে রাষ্ট্র মেরামতের কথা সামনে আনে তখন রাজনৈতিক আলোচনা, বিতর্ক গতি পায় ঠিকই, তবে আশা জাগায় না। সেখানে অবশ্যই সংস্কার-মেরামত দরকার। সেটি হলে স্মার্টনেস ফিরতেও পারে। বিএনপি যখন রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রায়নের পথে নিতে মেরামতের কথা বলে, তখন নিজের মেরামতের প্রসঙ্গটি আসে কি না সেটি একটি বড় জিজ্ঞাসা। দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা কতটুকু হয়, সেটি আরেক বড় প্রশ্ন। দলটির কাঠামো ও গঠনতন্ত্র এমন করা উচিত যেখানে গণতন্ত্র বিকাশ হওয়ার সুযোগ পাবে। যখন দু’বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবে না বলা হচ্ছে, তখন দেখা দরকার যে, নিজেরা কোন জায়গায় অবস্থান করছে। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো- বিরোধী দলে থাকতে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেন, তবে নিজেদের বেলায় তা মানেন না। নিজেদের মেরামত ও সত্যিকার স্মার্ট করার কথা ভাবেন না।
স্মার্ট উচ্চারণের সাথে সাথে মঞ্চ ভেঙে পড়ার দিনই টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের চতুর্থ বছর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন। এর বিপরীতে রেইনবো ন্যাশনের ক্যাম্পেইনে দেশ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি নেতারা। বোঝানোর চেষ্টা করছেন, কিভাবে রাষ্ট্র মেরামত করবেন তারা। আর এ রকম সময়েই বসেছে বিএনপিবিহীন সংসদের ২১তম অধিবেশন। এর উদ্বোধনী বক্তব্যে রাষ্ট্রপতির উপলব্ধি, বড় কঠিন সময়ে পড়েছে বাংলাদেশ। সময়টিকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘সন্ধিক্ষণ’ নামে। এর ব্যাখ্যা বিভিন্ন হতে পারে। ক্ষমতাসীনরা কাক্সিক্ষত স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য একটি স্মার্ট ইলেকশনের তাগিদ মাথায় নিচ্ছেন না। একইভাবে রেইনবো ন্যাশন গঠনের জন্য রেইনবোর আবহের গরজ বোধ করতে হবে। এদিকে বিএনপি বা কোনো দল না এলে নির্বাচন ঠেকে থাকবে না- আগের মতো এ সিদ্ধান্তের কথা খোলাসা করেছে সরকার। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে কী হয়, না গেলেই বা কোন পরিণতি বরণ করতে হয়- দুই অভিজ্ঞতায়ই সমৃদ্ধ দলটি। সে ক্ষেত্রে তাদের বিকল্প হচ্ছে নির্বাচন হতে না দেয়া। অবস্থাটা জটিল। এর মধ্যে আবার দু’দিকেই ভোট-জোটের ব্যতিক্রমী রিহার্সাল। ধরনেও ভিন্নতা। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ পুরনো মিত্রদের এক করার এন্তার চেষ্টা। এর মধ্যে লুকোচুরি নেই। ইসলামপন্থী দলগুলোর বড় অংশকে দৌড়ের ওপর রাখলেও হেফাজতকে স্মার্টলি আয়ত্ত করে নিয়েছে সরকার। সরকারের সাথে বোঝাপড়া আরো তুঙ্গে তাদের।
হেফাজতের বাইরে চরমোনাই হুজুরের ‘ইসলামী আন্দোলন’ও সরকারের সাথে মিলমিশে বেশ মাস্তিতে আছে। ডান বা ধর্মাশ্রয়ীদের নিয়ে এমন সমীকরণে আওয়াম লীগ-বিএনপি বামদেরও ছাড় দেয় না। আয়ত্ত করতে না পারলে আবার গালমন্দও করে। নাস্তিক-মুরতাদ নামে বদনাম করে। এবার বিএনপির ছকে কেবল অতি বাম, অতি ডান নয়; মধ্যপন্থী কয়েকটি মহলও এখন সরকারের বিরুদ্ধে মিলেমিশে একাকার। তারা বিএনপির প্রতি সন্তুষ্ট বা দলটির ঘোরতর পক্ষ নিয়েছে এমনও নয়। তাদের অবস্থান আপনাআপনি চলে যাচ্ছে বিএনপির দিকে ও সরকারের বিপরীতে। তাদের বকা দেয়া হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। বামরা কি করে বিএনপির দিকে যায়, এমন খেদোক্তিও করা হয়েছে। যার বেনিফিট নিচ্ছে বিএনপি। জোটের জট না পাকিয়ে সহযাত্রী বাড়াচ্ছে বিএনপি। ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আনবে সেই ওয়াদা দিচ্ছে ডানে-বামে সব দিকে। কেবল জামায়াতসহ ডান নয়, বাম কট্টরসহ মধ্য ঘরানার অনেকেও যুগপতের নামে মাঠে তৎপর। বিএনপির সাথে অভিন্ন তারিখে গণমিছিল, গণঅবস্থান, গণসমাবেশ ধরনের নানা কর্মসূচি চলছে তাদের। ভেতরে ভেতরে এসব দলকে কাছে নেয়ার চেষ্টা আছে সরকারের। সফল না হওয়ায় এখন মোকাবেলায় সরকারের যারপরনাই তৎপরতাও লক্ষণীয়। পুলিশ নিয়ে মাঠে নামছে, সাবেক মিত্রদেরও টানছে। ১৪ দল তাজা করছে। হেফাজতের পাশাপাশি, তরিকত ফেডারেশন, চরমোনাই, জাকের পার্টিকেও পাশে রাখছে। এই চরিত্রের স্মার্ট ও মেরামতের শিকারে এখন বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]