মেনন, দিলীপ ইনুরা, বাম নন, “জয় শ্রীরাম” এর পূজারী

 আমার দেশ
২ মে ২০২৩

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

ভারতে ক্ষমতাসীন কট্টর হিন্দু, ফ্যাসিস্ট দল বিজেপির রাজনৈতিক শ্লোগান হলো, “জয় শ্রীরাম”। এই শ্লোগান দিয়েই তারা সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়, মসজিদ ধ্বংস করে, মুসলমানদের বাড়িতে আগুন লাগায় এবং তাদের নারীদের সম্ভ্রমহানী করে। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে বন্দি একজন বিরোধী দলীয়, মুসলমান সংসদ সদস্য এবং তার ভাইকে পুলিশের হেফাজতে, প্রশাসনের যোগসাজসে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তিন ভাড়াটে খুনি দিয়ে গুলি করে হত্যা করানোর পর সেই খুনিরাও জোরেশোরে “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দিয়েছে। সাংবাদিকের ছদ্মবেশে এই খুনিদের প্রশাসন কর্তৃক সুরক্ষা প্রদানসমেত আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করার পেছনে উত্তর প্রদেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদি মুখ্যমন্ত্রি কথিত যোগী আদিত্যনাথের (প্রকৃত নাম, অজয় মোহন সিং) ব্যক্তিগত নির্দেশ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। উত্তর প্রদেশের সংসদে দাঁড়িয়ে আদিত্যনাথ ইতোপূর্বে প্রকাশ্যে আতিক পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। সংসদ সদস্য আতিক আহমেদকে হত্যার মাত্র দুই দিন আগে তার জেলে বন্দি তরুন ছেলেকেও উত্তর প্রদেশের পুলিশ ভুয়া এনকাউন্টারে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। এখন আতিক আহমেদের স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য আদিত্যনাথের পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। বলিউডের কোন সিনেমার দৃশ্যের মত মুসলমান খুন করে এবং বিজেপি-আরএসএস’র “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দিয়ে সেই তিন ভাড়াটে খুনি প্রচন্ড মুসলমানবিদ্বেষী ভারতীয় মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং সোস্যাল মিডিয়ায় জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেটে এ বিষয়ে সার্চ দিলেই আমার লেখার প্রমাণ পাবেন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠী ১৯৭১ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার সাফল্যের কারণে একদা পরম ইন্দিরাভক্ত হলেও বর্তমানে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির প্রকাশ্য মুসলমানবিদ্বেষী রাজনীতির ঘোরতর সমর্থক। তাদের এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন নিয়ে সম্পাদকীয় রচনার কোন উৎসাহ আমি পোষণ করি না। আমি বাংলাদেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ, বামপন্থী নেতাদের স্বরূপ বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে আজকের সম্পাদকীয় লিখছি। দেশটিতে প্রধানত: দিল্লিপন্থী মিডিয়ার কল্যাণে রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, দিলীপ বড়ুয়া এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মার্কা জনবিচ্ছিন্ন ও ধিকৃত বাম রাজনীতিবিদদের মহান, আদর্শবান সব রাজনৈতিক নেতা বানানো হয়েছে।  দেশের মানুষ কোন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারলে এই নেতাদের কারো অবশ্য জামানত থাকবে না। কিন্তু, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার জাতীয় হিন্দুত্ববাদের সমর্থক পত্রিকায় এরা এক একজন জাতীয় নেতা। উভয় পত্রিকার সম্পাদক অবশ্য বাম ঘরানা থেকেই এসেছেন। প্রথম আলোর মতিউর রহমান মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিবি’র মুখপত্র ‘একতা’র সম্পাদক ছিলেন। ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনামও ছাত্রজীবনে মস্কোপন্থী দলের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা বিশ্বে চরম “ইসলামোফোবিয়া” উদ্ভূত ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের সুবাদে একদা বামপন্থী সম্পাদকদ্বয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান প্রশাসন নির্বিশেষে জোরালো সমর্থন লাভে সফল হয়েছেন। ওদিকে দিল্লির সাথেও তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কোন ভাটা পড়ে নাই। ২০০৮ সালে ভারত, আমেরিকা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যোগসাজসের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার পিছনে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমানে হাসিনা এবং মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের মধ্যে যে দ্বন্দ চলছে সেটা কেবল ক্ষমতা নিয়েই, সেখানে “জয় শ্রীরাম” নিয়ে আদর্শিক কোন বিরোধ নাই।

যাই হোক, উল্লিখিত চার বাম নেতার মধ্যে প্রথম তিনজন গত পনেরো বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মন্ত্রি হয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। কথিত বাম দিলীপ বড়ুয়া তো পরিবারের সবার জন্য আলাদা করে গুনে গুনে সরকারী প্লটও নিয়েছেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ললাটে এখনও মন্ত্রিত্বের টিকা না লাগলেও, শেখ হাসিনা এই বছরের শেষে আর একটি ২০১৪ অথবা ২০১৮ স্টাইলে নির্বাচনী তামাশা করে ক্ষমতায় টিকে যেতে পারলে তার মন্ত্রিত্বের খায়েশও পূর্ণ হতে পারে। চার নেতার বাম রাজনীতির কেবলায় অবশ্য পার্থক্য আছে।

রাশেদ খান মেনন এবং দিলীপ বড়ুয়ার প্রধান কেবলা বেইজিং। প্রেসিডেন্ট শী জিনপিং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অনেক পূর্বেই চীন মাও এর বিপ্লবী আদর্শ থেকে সরে গেলেও মেনন এবং দিলীপের কেবলায় পরিবর্তন ঘটে নাই। বেইজিং এদের সাথে সর্বদাই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। হাসানুল হক ইনুর কেবলা বরাবরই ভারতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতবিরোধী দলের ছদ্মবেশে জাসদের উত্থান হলেও দলটি যে ভারতেরই বি-টিম ছিল এটা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। আমার ধারনা মেজর জলিলসহ জাসদের অনেক নেতাই দিল্লির খেলা ধরতে পারেন নাই। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ সংস্থা স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডার এবং গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর অত্যন্ত প্রভাবশালী উপদেষ্টা জেনারেল উবানের কাছ থেকে সরাসরি ট্রেনিং পাওয়া ইনুর মতো ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বাছাই করা নেতারা চটকদার “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” শ্লোগানের আড়ালে বাংলাদেশে বরাবরই দিল্লির এজেন্টের ভূমিকা পালন করেছেন। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান মুক্তিযুদ্ধকালে জেনারেল উবানের অধীনেই জলপাইগুড়িতে আঞ্চলিক অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। এক সময়ের জাসদ নেতা, মহিউদ্দিন আহমেদ লিখিত বই, “জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি” অনুসারে সিরাজুল আলম খান ১৯৬৩ সালেই ছাত্র লীগের অভ্যন্তরে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করার জন্য একটি গোপন সেল তৈরি করেছিলেন। উল্লেখ্য, শেখ মুজিব একই জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক খুনি বাহিনী, “জাতীয় রক্ষী বাহিনী” প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার জন্য সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন। শেখ মুজিব, সিরাজুল আলম খান এবং ইনুদের গোড়া বরাবর সেই এক দিল্লিতেই ছিল।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে মস্কো লাইনের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন করেই ডাকসু’র ভিপি হয়েছিলেন। শেখ মুজিব মস্কোপন্থী বামদের (সিপিবি এবং ন্যাপ-মোজাফ্ফর) সাথে নিয়েই ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র হরণ করেছিলেন। সাবেক কেজিবি প্রধান ও বর্তমান রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশাসনের সাথে সেলিমের সম্পর্কের বিষয়ে আমার জানা নাই। তাছাড়া, সোভিয়েট ইউনিয়নের নাটকীয় পতনের পর মস্কো ঘর সামলাতে ব্যস্ত থাকায় প্রায় দুই দশক আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নই ছিল বলা যায়। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ অপচয় করে রাশিয়ার প্রযুক্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের চুক্তি করার পর থেকে (আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত অন্তত: ১০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ শেখ পরিবার, আওয়ামী ব্যবসায়ী এবং রাশিয়ান এজেন্টরা লুটপাট করেছে।) মস্কো পুনরায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে। এনিয়ে ওয়াশিংটনের সাথে ঢাকার বেশ টানাপোড়েনও চলছে।

যাই হোক, বাম নেতাদের প্রধান কেবলা মস্কো কিংবা বেইজিং, যেখানেই থাকুক না কেন, সেই পাকিস্তান আমল থেকেই তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে সকল কমিউনিস্ট আন্দোলনের কলকাঠি ভারত থেকেই নাড়া হয়েছে। আজকের প্রজন্ম হয়ত জানেই না যে, পাকিস্তান আমলে সংখ্যাগুরু মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য হিন্দু কমিউনিস্ট নেতারা মুসলমান নামের আড়ালে রাজনীতি করতেন। এমনকি ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনও শুরু হয়েছিল “তমদ্দুন মজলিশ” নামে উর্দু ও ফারসি শব্দের সমাহারে গঠিত সংগঠনের ব্যানারে। কোন বাংলা শব্দ সেখানে ছিল না। যেমন “শহীদ মিনার” নামের মধ্যেও কোন বাংলা শব্দ নাই। তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বের অধিকাংশ সদস্য কট্টর সেক্যুলার ভাবধারার হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র অব্যবহিত পরেই সরাসরি ইসলামবিরোধী অবস্থান নেওয়া তৎকালিন রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নেতাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাঙ্গালী মুসলমানের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ভারতীয়করণ করে প্রকাশ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলতে আরো প্রায় দুই দশক সময় লেগেছিল। ষাটের দশকের মধ্যেই বাংলার সংখ্যাগুরু মুসলমান জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দু:খের প্রতি সর্বদা উদাসীন, জমিদারনন্দন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ দেশের শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মুসলমানের দেবতায় পরিণত হয়ে গেছিলেন। খুবই সহজে ধোঁকায় পড়ার বোকামি থেকে বাঙ্গালী মুসলমান আজও মুক্ত হতে পেরেছে অবস্থাদৃষ্টে আমার কাছে এমনটা মনে হয় না।

মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ায় এবং আর একটি নির্বাচনের সময় সন্নিকট হওয়ার প্রেক্ষাপটে মেনন, ইনু এবং দিলীপ বড়ুয়া গং সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চটকদার, সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আবারও বাংলাদেশের ইতিহাসবিমুখ জনগণকে বিভ্রান্ত করে লাইমলাইটে আসার চেষ্টা করছেন। এদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। অবশ্য সেই আহ্বানে কোন কাজ হওয়ার ব্যাপারে আমি মোটেই আশাবাদি নই। গত প্রায় দুই দশকে আমার প্রায় সকল সাবধান বাণী বিফলেই গেছে। মেনন, ইনু, বড়ুয়াসহ বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সকল সহযোগী এবং হিন্দুত্ববাদ আমদানি করে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়ার সকল কারবারিরা একদিন জনগণের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা করছি। অন্যথায় আপনারাও “জয় শ্রীরাম” শ্লোগান দেওয়ার চর্চা এখনই আরম্ভ করে দিতে পারেন।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
০২/০৫/২০২৩