ইসমাইল আলী: নির্মাণের দুই দশকের মাথায় ঝুঁকিতে পড়ে মেঘনা সেতু। পিলারের গোড়ায় মাটি সরে যাওয়ায় ভারী যান চলাচলের সময় কেঁপে উঠত সেতুটি। আর দুই লেনের সেতুটির সক্ষমতা ছিলও কম। এতে মাত্র তিন দশকের মধ্যে নির্মাণ করতে হয়েছে দ্বিতীয় মেঘনা সেতু।
এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণকালে যমুনা নদী অতিরিক্ত শাসন করায় পরিবেশের ওপর পড়ে বিরূপ প্রভাব। এতে যমুনার ভাঙন প্রবণতা বেড়ে গেছে। এখনও প্রতি বছর সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙছে যমুনা নদী।
মেঘনা ও বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রায় দুই দশক পর পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির স্টিল অবকাঠামোয় এ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে পদ্মা সেতুতেও রয়ে গেছে মেঘনা ও যমুনার নদীর ঝুঁকি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে নিবীড় পরিবীক্ষণের উদ্যোগ নেয় আইএমইডি। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সম্প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন ঝুঁকি তুলে ধরা হয়েছে।
সূত্রমতে, ১৯৯১ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় মেঘনা সেতু। আয়ুষ্কাল ১০০ বছর ধরা হলেও ২০ বছর না যেতেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে সেতুটি। ১২টি পিলার বিশিষ্ট মেঘনা সেতুর ছয়টির গোড়ার দিকে ৫২ থেকে ৬৫ ফুট পর্যন্ত জায়গার মাটি সরে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেতুটি মেরামত করার পাশাপাশি নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুটির পিলারগুলোর পাইল ১৩৩ থেকে ১৪৬ ফুট পর্যন্ত গভীর হলেও এগুলোর গোড়ার মাটি সরে যাওয়ায় ভারী যান চলাচলের সময় সেতুটি কেঁপে উঠত।।
এদিকে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও পিলারের গোড়ায় মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে মনে করছে আইএমইডি। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্মা নদী অত্যন্ত খরস্রোতের বিধায় সেতুর পিয়ারের (পিলার) স্থলে স্কাউরিং (গোড়ায় মাটি সরে যাওয়া) সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রকল্পটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট টিমের প্রধান সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীও এ ধরনের ঝুঁকির কথা একাধিকবার বলেছেন।
তথ্যমতে, পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে ২০টিতে রয়েছে ৬টি করে পাইল। বাকি ২২টি পাইল রয়েছে ৭টি করে। এগুলোর গড় গভীরতা ১০৮ মিটার। তবে খরস্রোতের কারণে পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে এসব পিলারের গোড়ায় ৬০ মিটার (প্রায় ২০০ ফুট) পর্যন্ত গর্ত তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মতিন শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর পিলারের নিচে পাইলের গড় দৈর্ঘ্য ১০৮ মিটার। তবে খরস্রোতের কারণে পিলারের গোড়ায় ৬০ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য নদীর তলদেশ থেকে ৬০ মিটার পর্যন্ত মাটি নেই ধরেই সেতুর পাইলের ডিজাইন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। আর ৬০ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরি হলেও আরও ৪৮ মিটার (প্রায় ১৬০ ফুট) পাইল মাটির নিচে থেকে যাবে। ফলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তিনি আরও বলেন, নদী খরস্রোত হওয়ার আরেকটি ইতিবাচক দিকও আছে। এতে শুধু পিলারের গোড়ায় গর্ত তৈরি হয় না, অন্য জায়গার মাটি বয়ে এনে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভরাটের সুযোগও থাকে। তবে বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। গর্ত তৈরি হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভরাট না হলে পাথর, বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভরাটের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে বর্ষায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের স্থানে যমুনা নদীর প্রস্থ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কিলোমিটার, যা শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৭ কিলোমিটার। এজন্য নির্মাণের আগে নদী শাসনের জন্য সেতুটি কমপক্ষে ৭ কিলোমিটার নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তা না হলে সেতুর অবস্থান কিছুটা ভাটিতে সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয় নদী শাসনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে কোনোটিই মানা হয়নি। বরং দুই প্রান্তে গাইড বাঁধ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়।
যদিও এর ফলাফল হয় ভালো হয়নি। ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের সময় নদী শাসনের পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য যমুনার অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা হয়। নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সে মূল্যায়ন কার্যক্রমে যমুনা নদী শাসনের বিভিন্ন দিক বেরিয়ে আসে। এ-সম্পর্কিত ‘পারফরম্যান্স রিভিউ অব যমুনা ব্রিজ রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস ১৯৯৭-২০০৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যমুনার দুই তীরে নির্মিত গাইড বাঁধ সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছে। এটা অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হলেও এখন এর কুফল দেখা যাচ্ছে। এছাড়া গাইড বাঁধের গভীরতাও কম। এতে সেতুর অবস্থান ও সংযোগ সড়ক রক্ষা হলেও তীর ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না।
এতে আরও বলা হয়, যমুনা নদীর গঠন মূলত মেয়েদের চুলের বিণুনি বেল্টের (ব্রেইড বেল্ট) মতো। আর যে স্থানে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা মূলত কর্দমাক্ত। এটা মাটির ক্ষয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নদী ভাঙন রোধে গাইড বাঁধ উভয় দিকে আরও ৫-১০ কিলোমিটার বাড়ানো উচিত ছিল।
এদিকে আইএমইডির প্রতিবেদনে পদ্মা নদী শাসনের ঝুঁকি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যদিও পদ্মা নদীর শাসন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ নদী শাসনের দৈর্ঘ্য একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে।
সেতু বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৪ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই পরিচালনা করে জাপানের নিপ্পন কোয়াই প্রাইভেট লিমিটেড। সে সময় মাওয়া প্রান্তে ছয় ও জাজিরা প্রান্তে ১৬ কিলোমিটার নদী শাসনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের সময় নদী শাসনের দৈর্ঘ্য কমানো হয়। ১৯৯৪ থেকে ২০০৮ সালের নদী ভাঙনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬ ও জাজিরা প্রান্তে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদী শাসনের সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের পর থেকে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বড় আকারের ভাঙন দেখা দেয়। এজন্য জাজিরা প্রান্তের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষায় পৃথক প্রকল্প নেওয়া হয়। এছাড়া মাওয়ায় নদী ভাঙন রোধে আরও ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার অতিরিক্ত নদী শাসন করতে হয়।
যদিও এ ধরনের নদী শাসনের পরও ঝুঁকি থেকে যায় বলে মনে করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, নদীর প্রকৃতি হলো, সে শাসন মানতে চায় না। এজন্য নদী শাসন করা কঠিন।
যমুনার ভাঙন রোধে গঠিত মনিটরিং সেলে পাঁচ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ড. শামছুল হক বলেন, যমুনা নদী অতিরিক্ত মাত্রায় শাসনের ফলে কিছু বিরূপ প্রভাব দেখা যাবে, তা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। এজন্য সেতুটি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাইয়ের পরামর্শে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এছাড়া বুয়েট বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছিল, যা ঠিকমতো মানা হয়নি। ফলে যমুনা নদীর হিংস্রতা ক্রমশ বাড়ছে। তবে পদ্মা ক্ষেত্রে বিষয়গুলো ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করলে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে ঝুঁকি কমানো যাবে।
Source: sharebiz.net