একরামুল হক রাজনীতি করতেন। টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন ১২ বছর। পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে তাঁর চারপাশে কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। দেখেশুনে নিজের বাবাকে নিয়ে নিশ্চয় কিছুটা গৌরবের বোধ ছিল দুই মেয়ের। কিন্তু হঠাৎ একদিন তারা জানতে পারল তাদের বাবা কত অসহায়! কথিত মাদক ব্যবসার অভিযোগে তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন র্যাবের কয়েকজন সদস্য। হয়তো জিজ্ঞাসাবাদের সময়টুকুও অপচয় করতে চাননি তাঁরা। ফলে একরাম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও পাননি। ফোনে কথা বলার সময় বাবাকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতে শুনে বিস্মিত ও বিপন্ন মেয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘আব্বু, তুমি কাঁদতেছ যে?’
মুঠোফোনে একরামুল হক ও তাঁর মেয়ের কথোপকথন ঘটনাচক্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ভাইরাল হয়েছিল। একরামুল হকের মৃত্যুর পর সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। আমাদের ঘটনাবহুল দেশে এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা সাময়িক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও সময়ের নিয়মে চাপা পড়ে যায়। শুধু ভুলতে পারে না স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারটি; যে পরিবারের কাছে বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে ছিলেন তিনি। একরামের প্রসঙ্গও হয়তো হারিয়ে যেত বিস্মৃতির আড়ালে, যদি না সাম্প্রতিক সময়ে সেই টেকনাফ এলাকাতেই মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় হতো এবং আইনি প্রক্রিয়ায় টেকনাফ থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ছয় আসামির যাবজ্জীবনের রায় ঘোষিত হতো।
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিঃসন্দেহে স্বস্তি দিয়েছে মানুষকে। কিন্তু পাশাপাশি দুটি প্রশ্ন ওঠে, এ মামলার তদন্ত যত দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে, একরাম বা অন্যদের ক্ষেত্রে সেভাবে এগোয় না কেন? আইনের সুযোগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও যে ইতরবিশেষ আছে, একদিকে মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা আর অন্যদিকে একরামের পরিবারের এখনো মামলাই করতে না পারার বাস্তবতা যেন তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, একরামের ঘটনায় যথাসময়ে মামলা ও বিচার হলে মেজর সিনহাসহ পূর্বাপর ‘বন্দুকযুদ্ধে’–এর ঘটনাগুলো ঘটত কি না?
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিঃসন্দেহে স্বস্তি দিয়েছে মানুষকে। কিন্তু পাশাপাশি দুটি প্রশ্ন ওঠে, এ মামলার তদন্ত যত দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে, একরাম বা অন্যদের ক্ষেত্রে সেভাবে এগোয় না কেন? আইনের সুযোগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও যে ইতরবিশেষ আছে, একদিকে মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা আর অন্যদিকে একরামের পরিবারের এখনো মামলাই করতে না পারার বাস্তবতা যেন তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, একরামের ঘটনায় যথাসময়ে মামলা ও বিচার হলে মেজর সিনহাসহ পূর্বাপর ‘বন্দুকযুদ্ধে’–এর ঘটনাগুলো ঘটত কি না?
একরামের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মামলা করতে না পারায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্প্রতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি চিঠি দিয়েছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে। চিঠিতে ‘যেকোনো নাগরিকের বিচার চাওয়ার অধিকার আছে’ উল্লেখ করে একরামের স্ত্রীর অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ২৩ জানুয়ারির মধ্যে একটি প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও জেলা প্রশাসক নিরুত্তর। কথা হচ্ছে, এতকাল কেন এ বিষয়ে নির্বিকার ছিল মানবাধিকার কমিশন? অতঃপর যা-ও একটি উদ্যোগ নিল, তাতে জেলা প্রশাসকের আমল না দেওয়ার পেছনে যুক্তি কী?
জেলা প্রশাসক চিঠির বিষয়ে গুরুত্ব না দিলে মানবাধিকার কমিশন কী করতে পারে—এ প্রশ্নের উত্তরে কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কামালউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘কমিশন আইনের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমরা হাইকোর্টে রিট করতে পারি। তখন বিষয়টি হাইকোর্টের এখতিয়ারে চলে যাবে।’ মানবাধিকার কমিশন আদৌ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে, নাকি সিনহা হত্যা মামলার রায়ের সূত্রে চাঙা হওয়া ইস্যুটা চাপা পড়ে গেলে আগের মতোই বিষয়টা ভুলে যেতে চাইবে, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত একরাম যে প্রকৃত অপরাধী ছিলেন না, তা খোদ র্যাবের প্রতিবেদন থেকেই বোঝা যায়। তারা একরামের পরিচয় উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছিল, ‘একরামুল হক কমিশনার (৪৬), পিতা–মোজাহার মিয়া, নাজিরপাড়া, টেকনাফ পৌরসভা, টেকনাফ।’ পরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, একরামুলের বাবার নাম মোজাহার মিয়া নয়, তাঁর ঠিকানাও নাজিরপাড়া নয়। বরং এনামুল হক নামের অন্য একজন তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাবার নাম মোজাহার মিয়া ও ঠিকানা নাজিরপাড়া। একরামুলের মৃত্যুর পর সংবাদমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনার সময় একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, এ রকম অভিযান পরিচালনার সময় একটি–দুটি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে যেতে পারে।
মন্ত্রী মহোদয় হয়তো সংখ্যার বিচারে একটি–দুটি ভুলের গুরুত্বহীনতার কথা বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু আয়েশা ও তাঁর দুই কিশোরী মেয়ে প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করছে, একটি জীবন কত মূল্যবান! সম্প্রতি আয়েশার বাড়িতে গিয়ে প্রথম আলোর সাংবাদিক দেখেছেন, আস্তর খসে পড়া দেয়াল, ভাঙা দরজা-জানালা, একটি বিবর্ণ জরাজীর্ণ বাড়িতে কী নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে একরামের পরিবার। কোথায় গেল তাঁর নামে চাপিয়ে দেওয়া কাল্পনিক ইয়াবা ব্যবসার অর্থবিত্ত?
পথের পাশে দেয়ালে স্লোগান লিখতে যায়নি একরামুল হকের দুই মেয়ে তাহিয়াত ও নাহিয়ান। শুধু নিজেদের ঘরের দেয়ালে মার্কার কলম দিয়ে এলোমেলো লিখে রেখেছে ব্যথিত হৃদয়ের আকুতি, ‘আব্বু তুমি কোথায়?’ ‘তুমি কি আর জীবিত ফিরে আসবে না?’ ‘আব্বু তুমি কেন নাই?’ ‘আব্বু তুমি কখন আসবা, প্লিজ চলে আস।’ ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে।’ ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে?’
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ আসবে না। কেউ জানবে না কত নির্ঘুম রাতের ক্রন্দনের পর এসব প্রশ্ন উঠে এসেছে দুই কিশোরীর মনে। দুই মন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন আয়েশাকে। তাঁরা সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন। মানবাধিকার কমিশন চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসনকে, তারাও হয়তো ভুলে যাবে। বিচারের বাণী কাঁদবে নিভৃতে। তার চেয়েও বড় কথা, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুর পর এই পরিবারের মানুষগুলোর খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান করবে কে, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারও কি কেউ আছে?
● বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক