ভাস্কর্যের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি তৈরি নিয়ে উত্তপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতি। ইতোমধ্যেই মূর্তি নিয়ে কথা বলায় ওয়াজ মাহফিলে বাঁধা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পাশাপাশি নির্মিত মূর্তি রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে আওয়ামী উচ্চ আদালতে রীট আবেদন করা হয়েছে রোববার। ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্য দেয়ায় দেশের দুই শীর্ষ আলেমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রস্তুতির খবরও বের হয়েছে ইতোমধ্যে। ভারতপন্থি টেলিভিশন চ্যানেল গুলোর টকশো থেকে গত কয়েকদিনই থেকেই শীর্ষ আলেমদের বিরুদ্ধে মামলার করার উস্কানি দেয়া হচ্ছিল।
এখানে উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজনৈতিক ইস্যুকে আওয়ামী উচ্চ আদালতের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছামত রায় নিয়ে আসছেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজনৈতিক মামলায় আওয়ামী হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ থেকে আইনের ব্যাখ্যা আসে শেখ হাসিনার ইচ্ছা অনুযায়ী। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও ঘোষক, সংবিধানের মূলনীতি থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধানকে বাদ দেওয়া এবং মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে সংবিধান থেকে বাদ দিতে আওয়ামী উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করেছেন শেখ হাসিনা। এই বিষয় গুলোতে উচ্চ আদালত শেখ হাসিনার ইচ্ছা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইনের ব্যাখ্যা দিয়েছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। একইভাবে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতেও শেখ হাসিনার মূল ভরসার জায়গাটি হচ্ছে আওয়ামী আদালত। রাজনীতির মূল প্রতিদ্বন্দ্বি বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দিয়ে সাজানো রায় দেয়ার মাধ্যমে বন্দি রাখা এবং রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসির রায়ও এসেছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। একই ফর্মূলায় ভাস্কর্যের নামে রাজনীতির এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে নিজের মত করে নিয়ন্ত্রনে নিতে আওয়ামী হাইকোর্ট ব্যবহার করার কৌশল নেয়া হয়েছে।
এদিকে ভাস্কর্যের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানের বিরোধীতা করায় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করারও প্রস্তুতি নেয়ার খবর বের হয়েছে। পাশপাশি একই দিনে (রোববার) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের অবমাননা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত হানা’। ছাত্রলীগও (রোববার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যেখানে ওয়াজ মাহফিল হবে, সেখানে গিয়ে আগেই মাঠ দখলে নেয়ার জন্য। সামবেশে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান সংগঠনটির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘কোথাও ওয়াজ মাহফিলের খবর পেলে আগে থেকেই আপনারা সেখানে গিয়ে অবস্থান নেবেন। ওয়াজ মাহফিলে “পাকিস্তানপন্থী ও রাজাকারদের দোসর” কোনো বক্তা, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে কথা বললে দাঁতভাঙা জবাব দেবেন। তাঁদের সেখানেই প্রতিহত করবেন। কেউ কিছু বলে না বলে ওদের সাহস বেড়ে গেছে।’
ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ মাহফিলে ভাস্কর্য প্রসঙ্গে উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই বক্তাকে থামিয়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিতে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একটি মাহফিলে বক্তাকে থামিয়ে দিয়ে এক আওয়ামী নেতা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছেন। বক্তাকে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন কটুবাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে। উপস্থিত শ্রোতারা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ওই আওয়ামী নেতার প্রতি জুতা নিক্ষেপ শুরু করলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠতে দেখা যায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে। এক পর্যায়ে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেন সেখানে।
অপর দিকে সরকার পন্থি হিসাবে পরিচিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে গত শনিবার শীর্ষ ওলামাদের এক বৈঠক থেকে ভাস্কর্য ও মূর্তি নির্মান প্রসঙ্গে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পাঁচ দফা দাবী পেশ করা হয়েছে সরকারের প্রতি। তাদের ফতোয়ায় বলা হয়েছে ভাস্কার্য এবং মূর্তি একই জিনিস। ইসলাম কোনটারই অনুমোদন করে না। মূর্তির পরিবর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মিনার তৈরির পরামর্শ দিয়ে এই আলেমরা শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার আবেদনও জানিয়েছেন। শনিবার এই দাবী পেশ করার পরের দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের (মূর্তি) বিরোধীতা করাকে স্বাধীনতার বিরোধীতা বলে দাবী করে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে ছাত্রলীগ হুঙ্কার দিচ্ছে ওয়াজ মাহফিলের ময়দান দখলে নিতে।
অপরদিকে কুষ্টিয়ায় নির্মানাধীন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের অংশ বিশেষ ভেঙ্গে ফেলার অভিযোগে ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সংবাদ সম্মেলনে তাদের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে, মামুনুল হকের বক্তব্য দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়েই তারা ভাস্কর্য ভেঙ্গেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে পুরো এক বছর জুড়ে মুজিব বর্ষ ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এই মুজিব বর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার মোড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মান করা হচ্ছে। ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির বিপরীতে গিয়ে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।