- অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নাজমুল হুদা
- ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:০৮, আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭:১৫
যেকোনো জাতির পরিচয়ের জন্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিমাপ করা হয়। সমাজ চলমান। সমাজের সার্বিক অগ্রগতির রূপচিত্র সভ্যতা। অপর দিকে সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনাচরণের প্রতিচ্ছবি; সাধারণত মানুষের চলাফেরা, ওঠাবসা, পোশাক-আশাক, বাচনভঙ্গি ও শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গ। সভ্যতা ও সংস্কৃতি পরস্পর ওতপ্রোত জড়িত। এ দু’য়ের একটি ব্যতীত অপরটি অচল। কোনো জাতির সভ্যতাকে ধ্বংস করতে হলে তার সংস্কৃতিকে সর্বাগ্রে ধ্বংস করা প্রয়োজন। শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতির উন্নতির চাবিকাঠি। আবহমানকাল ধরে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি তার নিজস্ব গতিতে চলমান।
মহানবী সা:-এর মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল। মহানবী সা: অনুসারী সহচররা মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় মুসলিম জাতির অবদান চির ভাস্বর। মুসলিম খেলাফতের উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে পুরো পৃথিবী কমবেশি মুসলিম সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে চলত। মুসলিম জাতির অনুকরণে, অদ্যাবধি খ্রিষ্টান ধর্মযাজকরা মুসলিম জাতির পোশাকের অনুকরণে লম্বা কুর্তা ব্যবহার করে।
ভারতবর্ষের অমুসলিম জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অনেকে এখনো মুসলমানদের অনুকরণে শেরওয়ানি, কুর্তা ও পাজামা ব্যবহার করে। চলমান বিশ্বে মুসলিম জাতি শিক্ষায় পশ্চাৎপদ, যে কারণে তারা নিজেদের জাতীয় ঐতিহ্যকে ভুলতে বসেছে। ফলে সুযোগ বুঝে বিজাতীয়রা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মুসলিম জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
ধীরে ধীরে মুসলিম জাতি তাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনা ভাবধারা ও সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে পিছু হটছে। চেতনার সেই শূন্য জগতে বিজাতীয় চেতনা ও ভাবধারা ক্রমেই জেঁকে বসছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে বেশির ভাগ আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম জাতির জাতীয় পোশাক পাজামা, পাঞ্জাবি ও শেরওয়ানি কুর্তা পরতে অনীহা বোধ করেন। কেবল বিশেষ অনুষ্ঠান ও দুই ঈদে তাদেরকে পাজামা, পাঞ্জামি পরতে দেখা যায়। অপর দিকে বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারকরা সাধারণত ধুতি পাঞ্জাবি ও প্যান্ট-শার্ট পরে চলাফেরা করেন। বর্তমানে প্যান্ট-শার্ট মুসলিম জাতির বহুল ব্যবহৃত পোশাক হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। এমনকী স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের অনেকে শার্ট প্যান্ট পরে চলাফেরা করছেন। চলনে-বলনে আচার-আচারণে তাদের কাছে পশ্চিমা সংস্কৃতি ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে ইসলামী শরিয়ত খাদ্য গ্রহণের আগে দুই হাত পরিষ্কার করে, ধৌত করে ডান হাত দিয়ে খাদ্য গ্রহণের বিধান চালু করেছে। অথচ বর্তমানে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে হাতের পরিবর্তে চামচ ও ছুরি দিয়ে খাবার প্রচলন শুরু হয়েছে। এমনকি ডান হাতের পরিবর্তে বাম হাত দিয়ে খাদ্য গ্রহণ আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছে।
সালামের পরিবর্তে গুডমর্নিং ও গুডনাইট জাতীয় সাংস্কৃতিক শব্দ অনেকে ব্যবহার করছেন। অথচ অর্থের দিক দিয়ে আসসালামু আলাইকুম বাক্যের আভিধানিক অর্থের সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম ও জাতির অভিদনের তুলনা হয় না। যেমন- আসসালামু আলাইকুম শব্দের অর্থ হলো- ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’। প্রতিউত্তরে ওয়া আলাইকুম আসসালাম শব্দের অর্থ- ‘আপনার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক’।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সম্পর্কে বলা যায়, কোনো মানুষের পোশাক-আশাক ও প্রচলিত নামের মাধ্যমে সে মানুষের সংস্কৃতি, ধর্ম ও সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। যেমন- একজন মুসলিম তার সন্তানের নামকে ইসলামী পরিভাষা যেমন আব্দুর রহমান, আবদুল খালেক ইত্যাকার, আল্লাহ, নবী-রাসূল ও বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সাথে নামের মিল রেখে পরিচিত করে থাকেন। অপর দিকে, একজন অমুসলিম তাদের সন্তানের নামকরণে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের দেব-দেবী ও সৃষ্টিকর্তার নামের সাথে সম্পৃক্ত করে নাম রেখে থাকে। যেমন- হিন্দু সম্প্রদায় তাদের সন্তানদের ইন্দ্র, দুর্গা, দেব, গণেশ নামে নামকরণ করে থাকে। ঠিক তেমনি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা তাদের সন্তানদেরকে ডেভিড, চার্লস, ক্রিস্টোফার ইত্যাদি নামে নামকরণ করে থাকে।
বর্তমানে মুসলিম জাতি বিশেষত আমাদের দেশের মুসলিমরা তাদের সন্তানদের নামকরণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইসলামী সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষা করছেন না। যেমন- মুসলমানরা তাদের সন্তানদের মিন্টু, পিন্টু, রনি, সাগর, হৃদয়, রতন ইত্যাকার বিভিন্ন নামে নামকরণ করছেন যে কারণে প্রথম দর্শন ও শ্রবণে একজন মুসলিমকে তার নাম ও পোশাকের মাধ্যমে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তার ধর্মীয় পরিচিতি উদ্ধারের জন্য তার সাথে আলাপনের মাধ্যমে বা জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পরিচয় উদ্ধার করতে হয়।
স্থাপত্যশিল্প বা আবাসনের ক্ষেত্রে ও মুসলিম জাতির নিজস্ব আদর্শ রয়েছে। যেমন- পারস্যরীতির স্থাপত্য ও মোগল স্থাপত্যের কলাকৌশল পুরো প্রথিবীতে সমাদৃত। অথচ বর্তমানে একশ্রেণীর তথাকথিত মুসলিম বোদ্ধা তাদের স্থাপত্যরীতিতে অমুসলিম রীতি-নীতি যেমন- বিভিন্ন দেব-দেবী বা প্রাণীর মূর্তি স্থাপন করছেন, যা ইসলামী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
সম্প্রতি অতি প্রচলিত বাক্য যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ প্রচার করছেন- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ অর্থাৎ- সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতে পারবে ও সব ধর্মের উৎসবে যোগদান করতে পারবে। অথচ আমাদের দেশে দেখা যায়, মুসলমানরা অমুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যাপক হারে উৎসব পালনে অংশগ্রহণ করছে। অথচ মুসলমানদের জাতীয় ধর্মীয় উৎসব দুই ঈদে অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। ফলে মুসলিম সংস্কৃতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
পোশাকে-আশাকে চলনে-বলনে মুসলিম জাতির মধ্যে ক্রমাগত অমুসলিম সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করছে। যেমন- পাজামা পাঞ্জাবির পরিবর্তে মুসলমানরা প্যান্ট-শার্ট পরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ বিষয় হলো- বর্তমানে কিছু সংখ্যক মুসলমান নারী-পুরুষ একে অপরকে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাচ্ছেন ইসলামী শরিয়তে যা শিরক বা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। অধুনা আমাদের সমাজে পয়লা বৈশাখ বরণের উৎসব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এ দিন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর মুখের আদলের মুখোশ ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও রাজপথে আনন্দ উৎসব করছেন, যা কেবল ইসলামী সংস্কৃতি বহির্ভূতই নয়; বরং শালীনতারও পরিপন্থী। সম্প্রতি নতুন হ্যালোইন উৎসব পালনের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এ অনুষ্ঠানে আল্লাহ প্রদত্ত মুখাকৃতিকে বিকৃত করে বাদুড় বা কাল্পনিক প্রাণীর মুখাকৃতি অঙ্কন করে শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছে। জন্মদিন পালন এখন ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করেছে। জন্মদিনে মোমবাতির প্রজ্বলন অন্যতম আচার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জন্মদিনে গানবাদ্য সহকারে নারী-পুরুষ একত্রে নাচগানে মিলিত হয় যার মাধ্যমে অশালীনতা প্রসার লাভ করে।
আমরা জানি, মহানবী সা: অমুসলিম জাতির উপাসনালয় ক্ষতিসাধন বা ধ্বংস করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। অমুসলিমদের ধর্ম প্রতিপালনেও কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে মুসলিম জাতির চেতনার এতটাই অবনমন ঘটেছে যে, মুসলিম জাতির ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরবেও অবাধে অমুসলিমদের নিয়ে ওপেন কনসার্ট করা হচ্ছে যে কনসার্টে অর্ধ-উলঙ্গ নারীদের দিয়ে যৌনাবেদন সৃষ্টিকারী নাচগান করানো হচ্ছে। সৌদি আরবে হলিউডের অত্যাধুনিক চলচ্চিত্র, অর্ধ-উলঙ্গ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য বিদেশীদেরকে সিনেমা হল তৈরির অনুমোদন দেয়া হয়েছে যেখানে অহরহ অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শিত হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি আরব আমিরাতের দুবাইয়ে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে অমুসলিমদের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মন্দির নির্মিত হয়েছে। অথচ পুরো পৃথিবীতে মুসলিম রাষ্ট্র ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২০০ কোটি মুসলমানের জন্য বিজাতীয়রা কোনো মসজিদ নির্মাণ করেছে, এমন কোনো নিদর্শন নেই। মুসলিম জাতির সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মুসলিম জাতির মধ্য থেকে ইসলামী সংস্কৃতির বিদায়ঘণ্টা বেজে যাবে। মুসলিম জাতির পরিচিতি মুছে যাবে।