মুক্তি কবে?

দেশে বেশ লম্বা সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় ও সংসারের খরচ বাড়ায় দিশাহারা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাগামহীনভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি আয়। ফলে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে আর ঋণ করে সংসারের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এতে কাটছাঁট করে অনেক কষ্টে টেনেটুনে চলছে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। দেশে নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিল, রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত ছিল, এসব মোটামুটি কেটে গেছে। কিন্তু অর্থনীতির অনিশ্চয়তা কাটেনি। চলমান ডলার সংকটের মধ্যেই নতুন করে টাকার সংকটে পড়েছে সরকার। রেমিট্যান্স একটু ইতিবাচক হলেও রপ্তানি আয় কমছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভও কমছে।

সরকারের ব্যয় বেড়েছে। এর বিপরীতে আয় বাড়েনি বরং কমেছে। এদিকে নানা চেষ্টা করেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।  বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর। বিশেষ করে কঠিন চাপের মধ্যে আছেন মধ্য আয়ের মানুষ। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন।

রাজধানীতে কয়েকজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কথা- খুব টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে তাদের সংসার। সঞ্চয় ভেঙে ধার-দেনায় সংসার চালাচ্ছেন তারা। তারা বলেছেন, নতুন বছরে বাসা ভাড়া বেড়েছে, ছেয়েমেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তির ফিও বাড়তি। এরপর বাজারে অরাজকতা। বেতনের অল্প টাকায় সবকিছু সামাল দেয়া আর সম্ভব হচ্ছে না সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের। তাদের পিঠ একদম দেয়ালে ঠেকে গেছে। বাস্তবে সবকিছু এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে করে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সংসারের ব্যয়। বাড়িভাড়া, খাবার খরচ, শিক্ষা খরচ কমানোর সুযোগ নেই। কিন্তু আয় বাড়ছে না সেভাবে। এর প্রভাবে সাধারণ মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ধার-দেনায়ও সংসার চালাতে পারছেন না তারা। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। মাছ-গোশত, ডিম-দুধ এবং ফলসহ পুষ্টিকর খাবার বাজারের তালিকা থেকে বাদ দিয়েও সংসার চালাতে পারছে না স্বল্প আয়ের মানুষ।

সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অবস্থা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর। বিশেষ করে কঠিন চাপের মধ্যে আছেন মধ্য আয়ের মানুষ। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভোক্তাঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের সংসারের খরচ ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি অনেকের, বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের।

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শহিদুল ইসলাম। দুই সন্তানসহ ৪ জনের সংসার তার। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। বেতন পান ২৫ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া যেন কম লাগে সেজন্য থাকেন ভেতরের দিকে রাজধানীর এক প্রান্তে। তিনি বলেন, এই টাকায় সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে গেছে। বাসা ভাড়া দিয়ে আর বাজার করে পুরো মাস চলা যায় না। বেতন পাওয়ার ১০-১২ দিনে মধ্যে তা শেষ হয়ে যায়। বাকি দিনগুলো ধার-দেনা করে অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। গ্রামে বাবা-মা আছেন। বাড়িতে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা উল্টো আরও নিয়ে আসা লাগে। হঠাৎ করে কোনো আত্মীয় এলে খুবই চিন্তায় পড়তে হয়। আর চিকিৎসার কথা আসলে আর কোনো উপায় থাকে না। বড় ছেলেটাকে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। পরে খরচ কমাতে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করেছেন ছেলেকে।

শুধু শহিদুল আর মানিক নন, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে রাজধানীর বাসিন্দাদের অনেকেই সংসারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক টেনেটুনে খরচ করেও মাস শেষে তাদের কোনো সঞ্চয় নেই। কেউ কেউ খরচের লাগাম টানতে কেনাকাটা ও খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। তাতেও সংসারের হিসাবের খাতায় স্বস্তি ফিরছে না।
দেশে দ্রব্যমূল্যের এমন ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি এবং মানুষের নাভিশ্বাসের বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যদি সরকার কমাতে না পারে, তাহলে বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির সরকারি ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। তিনি বলেন, যে হিসেবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে সে হিসেবে মানুষের আয় বাড়েনি। এর জন্য মানুষের অনেক কষ্ট হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক গবেষণা বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগগিরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে শুধু মাত্র খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা।

বাজার পরিস্থিতি: সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের দাম আরও বেড়েছে। গত দুইদিনে পণ্যটির দাম ২০ টাকা বেড়েছে। এখন ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে, যা আগে ছিল ১০০ টাকা। তবে শীতকালীন প্রতিটি সবজি আগের দামে বিক্রি হলেও নতুন আলুর দাম কমেছে। গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতকালীন সব ধরনের সবজি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি মুলার দাম ৪০ টাকা, শিম ৭০ থেকে ৯০ টাকা, ফুলকপি ৪০ থেকে ৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পাকা টমেটো প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৬০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৩০ টাকা, কচুরমুখী ১০০ টাকা এবং গাজর ৩০ থেকে ৪০ টাকা।  এ ছাড়া বেগুনের কেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, খিরা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শসা ৭০ টাকা। বাজারে প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা দরে। পেঁপের কেজি ৪০ টাকা, লেবুর হালি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ধনেপাতার কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, কলার হালি ৩০ টাকা, জালি কুমড়া ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পিয়াজের কলি ৬০ টাকা ও কাঁচা মরিচের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এদিকে চলতি সপ্তাহে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। গত সপ্তাহে একই দামে বিক্রি হয়েছিল। তবে সোনালি, সোনালি হাইব্রিড মুরগির দাম কমেছে। বাজারগুলোতে সোনালি ২৮০ টাকা, সোনালি হাইব্রিড ২৬০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে এক ডজন লাল ডিম ১৩০ টাকা, হাঁসের ডিম ২০০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

manabzamin