মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা চাই

Daily Nayadiganta২৫ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজাকারদের তালিকা নিয়ে তেলেসমাতির পর আমার প্রতিবেশী চাচা প্রতিদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা কেন হলো না? তার আরো প্রশ্ন বাংলাদেশে রাজাকারের সংখ্যা বেশি না মুক্তিযোদ্ধাদের? এত দিনেও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন নিখুঁত হলো না- এরকম অনেক প্রশ্ন নাগরিক সাধারণের মনে ঘুরপাক খায়। এ যেন ছেলেবেলার কবিতা, ‘মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার/সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার’। আসলে বিষয়টা কবিতার মতোই। এ নিয়ে প্রশ্ন করা, ব্যাখ্যা চাওয়া এবং লেখাজোখাও বিপজ্জনক। প্রায় দীর্ঘ এক যুগ ধরে ক্ষমতাসীনরা রাজাকারদের তালিকা এত দীর্ঘ করে ফেলেছে যে, দেশে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এরা শহীদ জিয়াউর রহমানকে এদের বিশেষ পরিভাষা অনুযায়ী ‘রাজাকার’ বলে। তিনি নাকি কোনো মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, বরং আইএসের এজেন্ট ছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর সরকারই জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধের আর একজন সেরা নায়ক ‘বাঘা সিদ্দিকী’। বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে সম্ভবত আবদুল কাদের সিদ্দিকীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ‘বীর উত্তম’ খেতাবে অভিষিক্ত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা করায় তাকেও ‘রাজাকার’ বলেছে। মুক্তিযুদ্ধের আর একজন নায়ক এ কে খন্দকার তার গ্রন্থ ‘ভেতরে বাইরে’ একটি তথ্যগত বিভ্রান্তির কারণে শাসকদল কর্তৃক ‘রাজাকার’ বলে গালি শুনেছেন। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কর্মরত বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ যখন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ লেখেন তখন তিনি রাজাকার হয়ে যান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল তারা সবাই কি রাজাকার? অথচ একটি পক্ষ ভিন্নমত পোষণকারী ওই বিপুল জনগোষ্ঠীকেও রাজাকার বানাতে চায়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে মেজর জলিল নির্বাচন করেছিলেন। যতটা মনে পড়ে সেনানিবাস ও মিরপুরসহ এই নির্বাচনী এলাকা ছিল তখনকার ঢাকা-৬। সেখানে মেজর জলীল ৫০ হাজার ভোট পেয়েছিল। সরকারদলীয় একটি পত্রিকা হেডিং দিয়েছিল, ‘৫০ হাজার রাজাকার!’। লোকে বলে চোখে যদি হলুদ চশমা থাকে তাহলে সব কিছু হলুদ হয়ে যায়। বিগত ৫০ বছর ধরে ক্ষমতাসীনরা কেবল রাজাকারই খুঁজেছে। শহীদদের খুঁজে পায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বদল করেছে অনেকবার। তার মানে হচ্ছে এই যে, এর পেছনের রাজনীতিটিকেই তারা বড় করতে চেয়েছে। লেবু বারবার কচলালে যেমন তেতো হয়ে যায়, তেমনি তাদের তালিকাও এখন তেতো হয়ে গেছে। তারা নিজেরাই তালিকাটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এই প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়েছে এমন নয়। স্বাধীনতার স্মৃতি যখন টগবগে, রক্তের দাগ যখন শুকিয়ে যায়নি এবং প্রামাণ্য ইতিহাস যখন হাতের মুঠোয়- তখন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ তখন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তো দূরের কথা লাখ লাখ শহীদের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ দেয়নি। এটা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম কাজ, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’ তাদের তালিকা তৈরি করা। তখন ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত তাদের দখলে ছিল। থানা, জেলা, বিভাগপর্যায়ে প্রশাসনিক স্তরবিন্যস্ত ছিল। শুধু মাত্র একটি প্রজ্ঞাপন বা আদেশই যথেষ্ট ছিল। দলীয় পর্যায়ে শহীদদের একটি তালিকা তৈরির কথা জানা গিয়েছিল বটে তবে তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কারণ যারা বেঁচে ছিলেন তারা সুযোগ-সুবিধা পরিত্যক্ত গাড়িবাড়ি ও কল-কারখানা দখলে ব্যস্ত ছিলেন। এর বাইরে এক বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যারা ছিলেন প্রকৃতই দেশপ্রেমিক। তারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য লড়াই করেছেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নেয়াটাকেও প্রয়োজন মনে করেননি। এখনো কোথাও কোথাও তাদের দেখা মেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে আকাশ-পাতাল ব্যবধানের কথা আমরা শুনেছি। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর যারা মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তারা দেখলেন বিজয়ের পর সংখ্যা কল্পনাকে অতিক্রম করেছে। সে সময়ে এদেরকে সিক্সটিনথ ডিভিশন বা ১৬ ডিসেম্বরের পরবর্তী বাহিনী বলে উপহাস করা হতো। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি, লাইসেন্স-পারমিট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে। হাস্যকর হলেও সত্য যে, চার বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও পাওয়া গেছে। সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এই সে দিন কিছু সচিবের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এর কারণ মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটটি কোনো সম্মান মর্যাদার প্রতীক না হয়ে অসম্ভব সুযোগ-সুবিধার বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে যেহেতু ভর্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা আছে, প্রতি বছরই কর্তৃপক্ষকে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের মুখোমুখি হতে হয়। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সরকার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ সার্টিফিকেটকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছে। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে সব মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান এদের প্রাপ্য। অর্থ-বিত্ত ও সুযোগ-সুবিধার দ্বারা এর পরিমাপ হতে পারে না। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন করে বিরোধীদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তালিকাটি দেশের শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান-অবমাননার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্ভুক্ত তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, পলাশডাঙ্গা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত আবদুল লতিফ মির্জা, বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী শাহজাদা আবদুল মালেক খান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর জনাব গোলাম আরিফ টিপু, বরিশালের বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, মনীষা চৌধুরীর বাবা তপন কুমার চক্রবর্তী, ঝালকাঠির মৃত মুক্তিযোদ্ধা সামশুল আলম, পাথরঘাটা মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মুজিবল হক, সাবেক জাতীয় সংসদের সদস্য মজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ মনোনীত জাতীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী কছিম উদ্দিন এবং বগুড়া ও রাজশাহীর আরো পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। সেখানে ৯৭ জন হিন্দু ভদ্রজনের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ জন মহিলা। আরো রয়েছে, ৩৮ জন মুসলিম মহিলার নাম। যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সংখ্যালঘু দেখলেই হত্যা করত এবং মহিলারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে তখন এই তালিকা স্বাভাবিকভাবেই ক্রোধ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী মহোদয় স্বীকার করেছেন যে, তিনি তালিকাটি পর্যবেক্ষণ না করেই প্রকাশ করেছেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই পুরো দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা একটি সাবকমিটি গঠনের পর অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে এই তালিকাটি প্রণয়ন করেছেন। বিচার-বিশ্লেষণের নমুনা যদি এই হয়, তাহলে অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। তারা মানুষের সম্মানহানি ঘটিয়েছেন, সুনামের ক্ষতি করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশেষে বলেছেন যে, তার মন্ত্রণালয় রাজাকারদের তালিকা দেয়নি বরং ১৯৭২ সালে দালাল আইনে অভিযুক্তদের তালিকা দিয়েছে। এটা ভুলবশত ছাপা হয়েছে। তালিকাটি সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপনের পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বলেছে, এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ।

Ad byValueimpression

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াতসহ সামরিক ও বেসামরিক সরকার ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকার সময় হয়তো সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত কাগজপত্র কারসাজি করে রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিখে রাখতে পারে। এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল’। মন্ত্রী মহোদয়ের এই উদাহরনটি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন আলমগীরের একটি মন্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। রানা প্লাজা ধসের সময় জনাব আলমগীর বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা রানা প্লাজার পিলার ধরে ধাক্কা দেয়ায় ধস নেমেছে। একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী থেকে এ ধরনের মন্তব্য খুবই হাস্যকর। যা হোক, বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন করবেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেকোনো কথা এলে প্রথমেই আমাদের লাখো শহীদদের স্মরণ করতে হবে। সে কারণে জনাব চৌধুরীর প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

কোনো জাতির মুক্তিসংগ্রামই একক নিরবচ্ছিন্ন ও একচ্ছত্র নয়। আমাদের মুক্তি-সংগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক ধারার প্রাধান্য ছিল। অবশেষে পাকিস্তানি নির্বোধ নেতৃত্বের নির্মম ভূমিকার কারণে এ দেশের জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। গুটিকয়েক স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি বাদে আর সবাই ছিল সপক্ষ শক্তি। সেদিনের ইতিহাস, উপন্যাস, কাহিনী ও বাস্তব অভিজ্ঞতা গোটা জাতির একাত্মতার কথা বলে। আজকে যাদের রাজাকার বলে অভিহিত করা হচ্ছে তাদের অনেকেই অবশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, অস্ত্র দিয়েছিল, তথ্য দিয়েছিল। পাকিস্তানিরা তাদের পক্ষে জনসমর্থন এমনকি হিন্দুদের সমর্থন দেখানোর জন্য নাম রাজাকার তালিকায় প্রদর্শনও অসম্ভব ছিল না। শান্তি কমিটির অনেকেই এলাকায় পাকিস্তানি গজব থেকে জনগণকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। বলা হয়ে থাকে যে, শান্তি কমিটির বেশির ভাগ ছিল মুসলিম লীগ দলীয়। অবাক হওয়ার বিষয়, তাদের নেক্সট জেনারেশন অর্থাৎ মুসলিম লীগারদের প্রায় সব সন্তানই ছিল ছাত্রলীগের কর্মী। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা। আমি আশপাশের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কারণেই এ কথা বলছি। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, একই পরিবারের দুই ভাই দুই পক্ষে কাজ করেছে। আবার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও বিরোধ বিভাজন ব্যাপক। মুক্তিযুদ্ধের পরে আর একটি প্রবণতা গোটা জাতিকে পেয়ে বসে। আর তা হলো ব্যক্তিগত শত্রুতা। আদৌ যারা রাজাকার বা দালাল নয় এমন ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হত্যা করা হয়েছে। এরকম উদাহরণও রয়েছে। এই তালিকায় যে ভুল থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ‘কারণ প্রতিহিংসা, পূর্বশত্রুতাবশত আমরা অনেক কিছু করে থাকি’।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক আবেগে প্রতিশোধস্পৃহা তীব্র থাকলেও ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তখন শুরু হয় দালাল-রাজাকারদের পক্ষে আওয়ামী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তদবির। পরিস্থিতি যাতে রক্তারক্তির পর্যায়ে না যায় সে জন্য বঙ্গবন্ধুর কড়া নির্দেশ ছিল। এই জাতির আবেগ, আন্তরিকতা তথা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুভূতি ছিল। এই বাস্তবতা সে দিনের সংবাদপত্রেও প্রতিফলিত হয়েছিল। জনপ্রিয় কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন আবেগময় ভাষায়। দৈনিক বাংলার নির্মল সেন দেশজুড়ে সবাইকে দালাল অভিযোগে অভিযুক্ত করার জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন। মওলানা ভাসানীসহ প্রায় সব রাজনীতিবিদ সাধারণ ক্ষমার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন, এত বড় একটি বিজয়ে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। পৃথিবী ইতিহাসের এ ধরনের সব মুক্তিযুদ্ধ ও বিপ্লব অবশেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা আসে। বঙ্গবন্ধু সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। এক দিকে জনগণের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য যারা খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে জড়িত ছিল তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। অপর দিকে যারা শুধু রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তথা যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ছিল না- তাদের সবাইকে ক্ষমা করেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, মতামতে বিভক্ত ও অস্থির সমাজকে স্থিতিশীলতা প্রদানের জন্য, জাতি গঠনে অভিন্ন ঐক্য সৃষ্টির জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তিময় পরিবেশের জন্য বঙ্গবন্ধু ওই মহানুভব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিকটজনদের স্মৃতি কথা থেকে তখনকার শীর্ষ রাজনীতিবিদ খান আবদুস সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও শাহ আজিজুর রহমানের প্রতি যে মানবিক ব্যবহারের উদাহরণ পাওয়া যায় তা সমসাময়িক রাজনীতির ইতিহাসে বিরল।

জিয়াউর রহমান পরবর্তীকালে এই ক্ষমার পরিধি সম্প্রসারিত করে দালাল আইন প্রত্যাহার করেছিলেন। বাংলাদেশ জাতিসত্তার অন্তর্নিহিত সতত আবেদনের কারণে এক্ষেত্রে আরো পুনর্গঠন ও পুনর্মূল্যায়নের ঘটনা ঘটে। তবে অপ্রিয় সত্য এই যে, বাংলাদেশে অব্যাহত ভাবাদর্শের দ্বন্দ্বের কারণে ক্ষমতার অদল-বদলে একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ক্ষোভ ক্রমশ ঘৃণায় পরিণত হয়। এটি একটি রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়। স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষের আদর্শিক দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু এবং পরবর্তী শাসকদের অনুসৃত ঐক্যের রাজনীতির পরিবর্তে বিভেদের রাজনীতি প্রধান্য অর্জন করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পুনরুত্থিত রাজনৈতিক বিরোধকে ‘কৃত্রিম, স্বল্পদৃষ্টি’র ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে যদি জাতীয় এক্যের এই অবস্থা দেখেতে হয় তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, ডান-বাম, ভালো-মন্দ, ধার্মিক-অধার্মিক, পাহাড়ি-সমতলী, বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবারই মাতৃভূমি এই বাংলাদেশ। কোনো বিশেষ অংশকে তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কারণে বৈষম্যের শিকার হতে দেয়া যায় না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই বিভাজন নীতি বঙ্গবন্ধু অনুসৃত ঐক্যের রাজনীতির বিপরীত। এখনকার আওয়ামী লীগ নেতারা যদি মনে করেন, তারা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল, তা যে শুধু বড় ভুল হবে তা-ই নয়, তা দেশকে বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। জনগণকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করা নয়, ঐক্যবদ্ধ করাই জাতীয় নেতার কাজ।’ (সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর)

বলা হয়েছে, রাজাকারদের সংশোধিত তালিকা আগামী ২৬ মার্চ প্রকাশিত হতে পারে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাইয়ের পর এটি প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সব দল ও মতের লোকেরা এক বাক্যে তালিকাটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন তাদের এই অবমাননা ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্য প্রায় ৫০ বছর পরে যেখানে তথ্য-প্রমাণাদি পাওয়া অবশ্যই সুকঠিন এবং কাজটি জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য সহায়ক নয়, সুতরাং এ ধরনের কাজ পরিত্যাজ্য। যতবারই তালিকা প্রণয়ন হবে ততবারই ভুল-শুদ্ধের লড়াই থাকবে। এ ধরনের নেতিবাচক কাজের মাধ্যমে রাজাকারদের প্রাধান্য না দিয়ে বরং ইতিবাচকভাবে প্রথমত মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর পর অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন শহীদদের তালিকা প্রণয়নে উদ্যোগ নিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক এই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তাদেরকে নৈতিক ও আর্থিকভাবে সহায়তা দেয়া যায়। দ্বিতীয়ত, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সর্বসম্মত তালিকা প্রকাশে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। সরকার বদলের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বদল হবে- এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সব পক্ষ থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সব বিবাদ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]