মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের হামলার মুখে শতাধিক সেনা ভারতে পালিয়ে আসার পর ভারতের স্বরাষ্ট্র ন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
আসাম পুলিশ কম্যান্ডোদের পাসিং আউট প্যারেডে তিনি এই ঘোষণা করেন শনিবার।
মিয়ানমার আর ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ বিনা ভিসায় একে অন্যের দেশে যাতায়াত করতে পারেন যে ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম বা এফএমআর অনুযায়ী, সেটাও আপাতত বন্ধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মি. শাহ।
তিনি এরকম সময়ে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তে বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যখন মাঝে মাঝেই মিয়ানমার থেকে সেদেশের সেনা সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র সহ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যে সংঘর্ষ চলছে, তার মধ্যেই এই সপ্তাহেও নতুন করে ২৭৮ জন মিয়ানমারের সেনা মিজোরামে পালিয়ে এসেছেন। নভেম্বর থেকে দফায় দফায় প্রায় ৬০০ জন সেনা সদস্য এভাবেই মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের আবার ফেরতও পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঘোষণার বিরোধিতা করেছে মিজোরামের অতি ক্ষমতাশালী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়াং মিজো এসোসিয়েশন এবং ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিল।
মিজো এবং নাগা জাতিগোষ্ঠীগুলি বলছে ভারত, বাংলাদেশ আর মিয়ানমার – তিন দেশেই তাদের আত্মীয় স্বজনরা বসবাস করেন একই জনজাতি-গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার কারণে। নিয়মিতই তারা যাতায়াত করতে পারেন। কিন্তু সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিলে অথবা এফএমআর স্থগিত রাখলে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ হয়ে যাবে।
অমিত শাহ কী বলেছেন?
অমিত শাহ বলেছেন, “মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত উন্মুক্ত। নরেন্দ্র মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই সীমান্তকে সুরক্ষিত করতে হবে। আর সেইজন্যই মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমান্তেই বেড়া তৈরি করা হবে, যেরকমটা রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে।”
“এখন সরকার বিনা বাধায় দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতও স্থগিত করছে,” জানিয়েছেন মি. শাহ।
মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এফএমআর নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম অনুযায়ী সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ সীমান্তের দুদিকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বিনা ভিসায় চলাচল করতে পারেন। তবে তার জন্য দুই দেশের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে আর অন্য দেশে গিয়ে সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকা যায়।
মিজো, নাগাদের কেন বিরোধিতা?
ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার পরিকল্পনার কথা আগে থেকেই অবশ্য জানা যাচ্ছিল।
মনিপুর আর মিয়ানমার সীমান্তে অবশ্য বেড়া দেওয়ার কাজও ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে ১০ কিলোমিটারে ওই কাজ চলছে, এরপরে আরও ৭০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়া হবে বলে মনিপুরের সরকারি সূত্রগুলি জানিয়েছে।
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালডুহোমা দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছিলেন। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ঘোষণার পরে শনিবার মিজোরামের ইয়াং মিজো এসোসিয়েশনও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার বিরোধিতা করেছে।
প্রবল ক্ষমতাশালী ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট লালমাছুয়ানা বিবিসি বাংলাকে এদিন বলেন, “আমাদের জো জনগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমার, ভারত আর বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। এরা সবাই একে অপরের আত্মীয়। যখন ভারত বা মিয়ানমার বা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তখন তো আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় নি যে আমরা কোথায় থাকতে চাই।
“সে কারণেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন আত্মীয় স্বজনরা। রাজনৈতিক সীমান্ত দিয়ে তো পরিবারের বন্ধন বন্ধ করা যায় না। এখন যদি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়, এফএমআর বন্ধ করে দেওয়া হয়, ব্যাপারটা অনেকটা বার্লিন ওয়ালের মতো হয়ে যাবে,” বলছিলেন মি. লালমাছুয়ানা।
ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিলও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আর এমএমআর বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটা স্মারকলিপি জমা দিয়েছে।
সেনা সদস্যদের পালিয়ে আসা
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন এক সময়ে ভারত মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন, যখন মাঝে মাঝেই মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা আরাকান আর্মির বিদ্রোহীদের ধাওয়া খেয়ে ভারতে পালিয়ে আসছেন।
আসাম রাইফেলসের সূত্রগুলি জানিয়েছে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তের কাছেই কার্মা নদী এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। সেনা ঘাঁটিও দখল করে নেয় আরাকান আর্মির সদস্যরা।
তারপরেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীও ২৭৮ জনের একটি দল অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে মিজোরামে প্রবেশ করে বলে আসাম রাইফেলসের সূত্রগুলি জানাচ্ছে।
ভারতে আসার পরে তাদের আপাতত আসাম রাইফেলসের শিবিরে রাখা হয়েছে। বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে এ নিয়ে মোট ৬৩৬ জন মিয়ানমার সেনা সদস্য ভারতে আশ্রয় নিলেন।
তারা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে ভারত। এর আগে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টারে করে একটি দলকে মনিপুরের মোরে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
এবছর জানুয়ারিতেও মিজোরামের রাজধানী আইজলে মিয়ানমারের সামরিক বিমান এসে তাদের দেশের সৈন্যদের ফেরত নিয়ে গেছে।
বারবার যেভাবে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা মিজোরামে ঢুকে পড়ছেন, তাকে খুব একটা ভাল চোখে দেখছেন না ইয়াং মিজো এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মি. লালমাছুয়ানা।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “হঠাৎ হঠাৎ বড় বড় বন্দুক আর গোলাবারুদ নিয়ে সামরিক পোশাক পরে তারা ভারতে চলে আসছে। ভারত সরকার তাদের আশ্রয় দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সীমান্ত অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষ তো ভয় পেয়ে যাচ্ছেন ওই সব অস্ত্রশস্ত্র দেখে। তারা যেসব এলাকায় থাকেন, সেখানে কাছাকাছি না আছে থানা, না সীমান্ত প্রহরা।
“মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা গ্রামে ঢুকে পড়লে স্থানীয় মানুষ যে থানায় খবর দেবে তাড়াতাড়ি সেই সুযোগও নেই। এটা উচিত হচ্ছে না। বারেবারে একই ঘটনা ঘটছে,” বলছিলেন মি. লালমাছুয়ানা।