মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের শাস্তি ঘোষণা করছে সামরিক আদালত। তবু বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটছেন বর্মি সেনাবাহিনীর একের পর এক জেনারেল। কেউ কেউ আত্মসমর্পণও করছেন। এতদিন মিয়ানমারের বেসামরিক মহলে সামরিক জান্তার সবচেয়ে বড় সমর্থক ধরা হতো উগ্র ভিক্ষুদের। আকস্মিকভাবেই জান্তাপ্রধান মিন হ্লাইং পদত্যাগ করে তার ডেপুটি সোয়ে উইনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুলেছে তারাও। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মিত্রদের কাছ থেকে তেমন কোনো সমর্থন পাচ্ছে না মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সামরিক জান্তার প্রতি আগের মতো সমর্থন দেখানো থেকে বিরত থাকছে চীনও। একের পর এক শহরের দখল চলে যাচ্ছে বিদ্রোহীদের হাতে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মিয়ানমারের পরিস্থিতি দিনে দিনে সামরিক জান্তার ক্ষমতায় টিকে থাকার আরো প্রতিকূল হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) কাছে ৪ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করে ২ হাজার ৪০০ জান্তা সেনা। তাদের মধ্যে অফিসার ছিল দুই শতাধিক। চীন সীমান্তের কাছে লাউক্কাই শহরে তীব্র লড়াইয়ের পর তারা আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে দেড় সহস্রাধিক সৈনিক ও তাদের পরিবার-পরিজনদের আটক না রেখে ছেড়ে দেয় এমএনডিএএ বিদ্রোহীরা। পরে আত্মসমর্পণের দায়ে তাদের মধ্যে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের আটক করে সামরিক জান্তা। মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন পাওয়া ছয় জেনারেলকেও ওই আত্মসমর্পণের দায়েই শাস্তি দেয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন লাউক্কাই সেনা হেডকোয়ার্টারের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোয়ে কিয়াও, কোকাং স্বশাসিত অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তুন তুন মিন্ট এবং ৫৫ ডিভিশনের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ মিও উইন। যাবজ্জীবন ঘোষিত অন্য তিন জেনারেলকে ইয়াঙ্গুনের ইনসাইন কারাগারে রাখা হয়েছে।
সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন সাবেক ক্যাপ্টেন কং থু উইন। যোগ দেন বেসামরিক নাগরিকদের আইন অমান্য আন্দোলনে। তিনি বলেন, ‘ঘাঁটি ছেড়ে পশ্চাদপসরণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান সেনাবাহিনীতে আগেও ছিল। জান্তার বস মিন অং হ্লাইং এখন যেসব জেনারেল ঘাঁটি সমর্পণ করছেন, তাদের বিষয়ে খুবই অধৈর্য মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছেন। বিশেষ করে বড় আয়তনের কমান্ড হেডকোয়ার্টারগুলোর পতনের ক্ষেত্রে তিনি বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের কঠোর শাস্তির উদ্দেশ্য হলো অন্যান্য কমান্ডারকে তাদের ঘাঁটি সমর্পণ থেকে বিরত রাখা।’
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, লাউক্কাইর পরাজয় মিন অং হ্লাইংয়ের জন্য পরিস্থিতিকে অনেক কঠিন করে তুলেছে। এমনকি সমর্থকরাও এখন তার পদত্যাগের দাবি তুলছেন। তার বিরুদ্ধে অদক্ষতা, স্বার্থপরতা ও মেরুদণ্ডহীনতার অভিযোগও তুলছেন ঘোর জান্তা সমর্থকদের অনেকে।
গত মঙ্গলবার মিয়ানমারের পার্বত্য শহর পাইন উ লুইনে এক সমাবেশে দেশটির ‘উগ্র ও সশস্ত্র’ হিসেবে পরিচিত ভিক্ষুদের এক সমাবেশ হয়। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় এসব ভিক্ষুকে উল্লেখ করা হয়েছে সামরিক জান্তার উগ্র সমর্থক হিসেবে। সমাবেশে ভিক্ষুদের অন্যতম নেতা পক কো ত আকস্মিকভাবেই দাবি তোলেন, মিন অং হ্লাইংকে পদত্যাগ করে তার ডেপুটি জেনারেল সোয়ে উইনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সোয়ে উইনের চেহারা দেখুন। এটাই একজন প্রকৃত সৈনিকের চেহারা। মিন অং হ্লাইং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাকে এখন বেসামরিক জীবনে ফিরে যেতে হবে।’
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, মিন অং হ্লাইং বরাবরই উগ্র ভিক্ষুদের সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট প্রয়াস রেখেছেন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মাধ্যমগুলো বরাবরই ঘটা করে বিভিন্ন মন্দিরে তার একের পর এক মূল্যবান উপহার-উপঢৌকন দেয়ার তথ্য প্রচার করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একের পর এক পরাজয় এখন জান্তাঘনিষ্ঠদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এ অবস্থায় মিন অং হ্লাইংয়ের পাশ থেকে তার পুরনো মিত্ররা সবাই একে একে সরে যাচ্ছে। ভিক্ষুদের সমর্থন হারানো সে ঘটনারই বহিঃপ্রকাশ।
মিয়ানমারে লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়ায় দেশটি থেকে প্রচুর মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে থাইল্যান্ডে। এতে মিয়ানমার সম্পর্কে থাইল্যান্ডের অবস্থানেও এখন পরিবর্তন আসছে। একই সঙ্গে বিষয়টিতে আরো ‘মানবিক ভূমিকা’ গ্রহণের ওপর জোর দিচ্ছে দেশটি। থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। বর্তমানে এ সীমান্ত দিয়ে সংঘাতে বাস্তুহারা হওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের বড় একটি অংশ আশ্রয় নিচ্ছে থাইল্যান্ডে।
ব্যাংকক পোস্ট জানিয়েছে, চলতি মাসের শুরুর দিকেই মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের জন্য নতুন আশ্রয় শিবির নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্নপ্রি বাহিদ্ধা-নুকারা। তিনি বলেন, ‘যদি সংঘাত বাড়ে তাহলে শুধু থাইল্যান্ড নয়, মিয়ানমার থেকে সবদিকেই উদ্বাস্তুর চাপ বাড়বে।’
থাইল্যান্ডের সাবেক সামরিক জান্তাপ্রধান প্রায়ুত চান ওচার সরকারের সঙ্গে মিয়ানমার জান্তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল দীর্ঘদিন। ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শ্রেথা থাভিসিনের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার এখন সে অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। মিয়ানমারের জান্তা পরিচালিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও দেশটির জান্তার সঙ্গে আগেকার মতো ঘনিষ্ঠতাও নেই শ্রেথা থাভিসিন সরকারের। এর চেয়ে থাই সরকার এখন তুলনামূলক মানবিক অবস্থান গ্রহণের দিকেই মনোযোগী হয়েছে বেশি।
জান্তার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া থেকে বিরত রয়েছে চীনও। মিয়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স পরিচালিত ১০২৭ অফেন্সিভের সফলতার পেছনে চীনেরও ভূমিকা রয়েছে বলে কোনো কোনো বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। স্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চীনের পক্ষ থেকে বিরোধিতা না থাকার কারণেই এখন পর্যন্ত এ সমরাভিযানে সফলতা পেয়েছে বিদ্রোহীরা। এছাড়া এ অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে জান্তার দূরত্বও বেড়েছে। মিয়ানমারের চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী শহরগুলোর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিনই দুশ্চিন্তায় ভুগেছে বেইজিং। কিন্তু এ বিষয়ে জান্তার পক্ষ থেকে শক্ত কোনো পদক্ষেপ না থাকায় চীনের মধ্যে বেশ অসন্তোষও ছিল।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন কোনোভাবেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অনুকূলে নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনেকেই দাবি করছেন, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘাতে জনবিচ্ছিন্ন নেপিদোর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
এখন পর্যন্ত লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি সামরিক জান্তার পুরোপুরি প্রতিকূলেই রয়েছে। এর পরিণতিও জান্তার ক্ষমতা ধরে রাখার অনুকূলে থাকবে না বলে বিশ্বাস অনেক পর্যবেক্ষকের।