মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে চলমান সংঘাত থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির সেনাবাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশসহ (বিজিপি) বিভিন্ন সংস্থার ৩২৯ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে তৈরি হয়েছে ঢাকা ও নেপিদোর মতানৈক্য। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ তাদের বঙ্গোপসাগর দিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. মনোয়ার হোসেন অনলাইনে যুক্ত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, মিয়ানমার তাদের বাহিনীর লোকদের নাফ নদ হয়ে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল। তাতে আপত্তি জানায় বাংলাদেশ। কারণ নাফ নদ দিয়ে ফেরত পাঠানোর সময় আরাকান আর্মি যদি কোনো হামলা চালায়, আর তাতে যদি কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটে, তাহলে তার দায় বাংলাদেশকেও নিতে হবে। বিকল্প পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ তাদের আকাশপথে ফেরত পাঠানোর বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাই এখন সমুদ্রপথে তাদের ফেরত পাঠানো হবে বলে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের আকাশপথে ফেরাতে চায় না। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের আশ্রিত লোকজনকে সমুদ্রপথে নেওয়ার বিষয়টি মিয়ানমার সামনে এনেছে। যদিও কিছুদিন আগে একই পরিস্থিতিতে ভারত থেকে আকাশপথে নিজ বাহিনীর লোকজনকে ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে। এর আগে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। আশা করা যায়, কয়েক দিনের মধ্যেই মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে।
বৈঠকে উপস্থিত আরেক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার বাহিনীর বাংলাদেশের প্রবেশের ধরন যদি বিশ্লেষণ করি, তবে দেখা যাবে, প্রথমে তারা উত্তর দিক থেকে প্রবেশ শুরু করে ধীরে ধীরে দক্ষিণে নেমেছে। যার মানে আরাকান আর্মি উত্তর দিক থেকে জান্তা সরকারের বাহিনীকে চাপাতে চাপাতে দক্ষিণে নামিয়েছে। এ ছাড়া রাখাইনের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের নিচের দিকের ইতোমধ্যে অনেক স্থান আরাকান আর্মির দখলে। ফলে রাখাইনে থাকা জান্তা সরকারের বাহিনীগুলোর বাংলাদেশে প্রবেশ ছাড়া কোনো উপায় নেই। তারা নাফ নদ দিয়ে ফেরত নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা বাস্তবসম্মত নয়।
তিনি বলেন, রাখাইনে থাকা ব্যাটালিয়নগুলোকে খোদ জান্তা সরকার পালিয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলেছে। এখন প্রায় পুরো রাখাইনের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার।
বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের ৩২৯ নাগরিককে কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে, সেটাই আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল। আলোচনায় মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যুক্ত ছিলেন। মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আজ (বুধবার) তিনি দেখা করেছেন। সেখানে সীমান্তের ঘটনাবলির প্রতিবাদ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে যারা এখানে আছেন, তাদের কীভাবে ফিরিয়ে নেবে– সেটা জানতে চেয়েছেন তিনি। এখানে যেসব লোক আছেন, তাদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তবে আমরা তাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আকাশপথে অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম। তারা সমুদ্র দিয়ে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। এসব লোককে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে নিরাপদ এবং দ্রুততম সময়ে করা যায়– সেটাই আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে।
মিয়ানমারের লোকজনকে এখন কোথায় রাখা হয়েছে– জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের এখন বিজিবির তত্ত্বাবধানে দুটি স্কুলে রাখা হয়েছে। সংখ্যা বাড়লে অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরে নেওয়া হবে। বিজিপির একটি ব্যাটালিয়নের বড় সংখ্যক বিশেষ করে তাদের লেফটেন্যান্ট কর্নেলসহ অনেকেই এবং আরেকটি ব্যাটালিয়নের অর্ধেক সদস্য চলে এসেছেন। সব মিলিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ হতে পারে সংখ্যাটা। আরও ১০০ সদস্য আসতে পারে বলে আমাদের অনুমান।
বাংলাদেশ বিবদমান পক্ষগুলোর একটির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে– এমন কোনো বার্তা কেউ দিচ্ছে কিনা– জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা তো মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করছি। আমাদের সঙ্গে নেপিদোতে, ঢাকায় সবখানেই তাদের যোগাযোগ আছে। এই মুহূর্তে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ দেখছি না। সবাইকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট যেন আমাদের না পোহাতে হয়– সেটাই আমাদের কাম্য। সেখানকার সংঘাতে এখানে প্রচুর মর্টার শেল পড়ছে, দু’জন মারা গেছেন। সীমান্তে উত্তেজনা ও ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেটারও অবসান চাই। আমরা এমনিতেই যথেষ্ট ঝামেলায় আছি। প্রত্যাবাসন ব্যাহত হচ্ছে। নতুন করে আর রোহিঙ্গা নিতে চাই না।
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে কিনা– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সরাসরি কোনো ঝুঁকি দেখছি না। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। এমন কোনো কিছু করব না, যাতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। বিজিবির সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে, যাতে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।
samakal