- বিবিসি নিউজ হিন্দি, দিল্লি
২০০৫ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর তৎকালীন প্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ এক সরকারি সফরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে গিয়েছিলেন।
পোর্ট ব্লেয়ারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানান, “মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য অনুসারে কোকো আইল্যান্ডে চীনের কোনও উপস্থিতি নেই। আমরা তাদের এই কথা বিশ্বাস করি।”
অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশের ওই সফরের মাসকয়েক আগেই মিয়ানমারের নৌবাহিনীর তখনকার প্রধান সো থিইন দিল্লিতে এসেছিলেন এবং ভারতীয় নৌপ্রধানের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল।
১৯৪৮য়ে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের আগে জাপানের সেনাবাহিনী কোকো আইল্যান্ডকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের একটি নৌঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করত। স্বাধীন দেশ মিয়ানমারের অংশ হওয়ার পর বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক অবধি কোকো আইল্যান্ডে ছিল একটি রেডার স্টেশন।
ভারতের জন্য নতুন উদ্বেগ
এই কোকো আইল্যান্ডকে কেন্দ্র করেই এখন একটি আন্তর্জাতিক বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যার মূলে আছে সুপরিচিত ব্রিটিশ পলিসি ইনস্টিটিউট ‘চ্যাটাাম হাউসে’র নতুন একটি রিপোর্ট।
তাদের ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, “সদ্য পাওয়া নির্ভরযোগ্য স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে দেখা যাচ্ছে ওই দ্বীপটিতে এখন অনেক বেশি কর্মকান্ড চলছে, যা ভারতের জন্য মোটেই সুখবর নয়।”
ওই উপগ্রহ চিত্র থেকে আরও আভাস পাওয়া যাচ্ছে, কোকো আইল্যান্ড থেকে মিয়ানমার সম্ভবত অচিরেই ‘মেরিটাইম সার্ভেল্যান্সে’র (সামুদ্রিক নজরদারি) জন্য গোয়েন্দা তথ্য আহরণ শুরু করবে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ এমনও মনে করেন মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবেশী চীনও ওই দ্বীপে তাদের নিজেদের জন্য একটি স্ট্র্যাটেজিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে।
স্যাটেলাইট ইমেজারির জগতে বিশ্বের অগ্রণী প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাক্সার টেকনোলজিস’ টানা বেশ কয়েক মাসের গবেষণার পর কোকো আইল্যান্ডের এই ছবিগুলো প্রকাশ করেছে।
ওই সব ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত ওই দ্বীপটিতে নানা ধরনের নির্মাণ কাজ চলছে পুরো দমে।
চ্যাটাম হাউসের হয়ে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন যারা, সেই গবেষক ড্যামিয়েন সাইমন ও জন পোলক জানাচ্ছেন, “এয়ারক্র্যাফটকে সুরক্ষিত রাখার জন্য দুটি হ্যাঙ্গার এবং থাকার জন্য কোয়ার্টার বানানো হয়েছে। আর সেখানে আগে থেকেই যে ১৩০০ মিটার লম্বা এয়ারস্ট্রিপ ছিল সেটার দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ২৩০০ মিটার করা হয়েছে।”
বিখ্যাত প্রতিরক্ষা সাময়িকী ‘জেন ডিফেন্স উইকলি’র মতে, “যুদ্ধবিমান এবং বড় আকারের সামরিক কার্গো এয়ারক্র্যাফটের ওঠানামার জন্যই ১৮০০ মিটার থেকে ২৪০০ মিটার লম্বা রানওয়ের প্রয়োজন হয়।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী সম্প্রতি কোকো আইল্যান্ডে এই কথিত তৎপরতা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে সব কার্যকরাপ প্রভাব ফেলতে পারে সেগুলোর ওপরে ভারত প্রতিনিয়ত নজর রেখে চলে।”
কোকো আইল্যান্ডে চীন বা অন্য কোনও দেশ সামরিক স্থাপনা বানাচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার অবশ্য এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।
সামরিক সরকারের মুখপাত্র মেজর জেনারেল জও মিন তুন এই সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে বলেছেন, “মিয়ানমার তার ভূখন্ডে কোনও বিদেশি সরকারকেই তাদের সামরিক ঘাঁটি বানাতে দেবে না।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত সরকারও এটা খুব ভাল করেই জানে যে ওই দ্বীপে শুধু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাই আছেন – যাদের কাজ হল মিয়ানমারকে সুরক্ষিত রাখা।”
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব
২০২১র ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই সেদেশে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ক্রমশ বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারে প্রভাব সবচেয়ে বেশি বাড়ছে চীনের।
সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটে তাদের আমদানি-রপ্তানি এবং জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য বিগত বহু দশক ধরেই চীনের নজর রয়েছে ‘মালাক্কা প্রণালী’র ওপর।
প্রায় ৮০০ কিলোমিটার লম্বা এই সামুদ্রিক রুটটি গেছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ভেতর দিয়ে। চীনের জাহাজ এই মালাক্কা প্রণালী দিয়ে গিয়েই বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তাদের পণ্য নিয়ে যায়।
মিয়ানমার যেহেতু এখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটেও ভুগছে, তাই এই পটভূমিতে তারা চীনের জন্য উপযুক্ত একটি ‘মিত্র দেশ’ হিসেবে উঠে আসতে পারে। প্রতিরক্ষা খাতেও চীন বহুদিন ধরেই মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ, সেখানে বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রেও চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম।
ভারতের নামী স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির কথায়, “যেভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলো মিয়ানমারকে ঘিরে ফেলেছে এবং বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে তাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করে আসছে তাতে মিয়ানমার আর চীনের ঘনিষ্ঠতাই আরও বেড়েছে।”
“চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে আসলে কতটা, তা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী খুব ভালভাবেই জানে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর চীনের কাছে যাওয়া ছাড়া তাদের উপায়টাই বা কী?”
ভারতের জন্য আরও একটা বড় উদ্বেগের বিষয় হল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশেই – যেমন কাম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনামে – এখন স্বৈরতন্ত্রী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে।
এর মধ্যে কাম্বোডিয়ার মতো বিভিন্ন দেশই নানা ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন, আন্তর্জাতিকভাবেও তারা অনেকটা একঘরে।
ঠিক এই কারণেই ২০২১ সালে ‘ফিউচার অব এশিয়া’ কনফারেন্সে ভাষণ দিতে গিয়ে কাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলেছিলেন, “চীনকে ভরসা না-করে আমার উপায় কী? চীনের কাছে না চাইলে আমি চাইবো-টা কার কাছে?”
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কাছে থেকেও হয়তো একদিন এই ধরনের বার্তা আসতে পারে – আর ভারতের জন্য অবশ্যই সেটা হবে বিরাট দু:সংবাদ।
মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সীমান্তের একদিকে রয়েছে ভারত, আর দক্ষিণে থাইল্যান্ড। মিয়ানমারে এমন বহু জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যেও যাদের পাওয়া যায়।
মিয়ানমার-গবেষক মেরি কালাহান আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে গ্লোবাল ফরেন পলিসি বিষয়ে পড়ান। ‘মেকিং এনিমিজ : ওয়ার অ্যান্ড স্টেটবিল্ডিং ইন বার্মা’ নামে তিনি একটি বই-ও লিখেছেন।
সেই মেরি কালাহানের মতে, “মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তাদের সরকার।”
তিনি বলছিলেন, “আর্মি যদি মিয়ানমারে নির্বাচন করাতেও যায়, তাদের বাইরের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। সেখানে তারা চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য আশা করতে পারে। এই দুটি দেশই তাদের অস্ত্রশস্ত্র জোগাচ্ছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সহযোগিতা করে আসছে।”
“এর পাশাপাশি আর একটা গ্রুপ হল ভারত ও থাইল্যান্ড – তাদেরও আবার মিয়ানমারে আলাদা নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক ও গোয়েন্দা প্রভাব বাড়ানোর জন্য এই সব দেশগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে – সেটা তাই খুব স্বাভাবিক”, মন্তব্য মেরি কালাহানের।
বস্তুত ঠিক একই ধরনের প্রশ্ন এখন উঠছে কোকো আইল্যান্ড নিয়েও – সেখানে যে ধরনের কার্যকলাপ এখন চোখে পড়ছে সেগুলো কি আড়াল থেকে আসলে চীনই করাচ্ছে?
এটাও বলা হচ্ছে যে চীন সম্ভবত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই দূর থেকে তাদের ‘বন্ধু’ মিয়ানমারকে সাহায্য করছে। ভারত মহাসাগরের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে কোকো আইল্যান্ড অবশ্যই তাদের বিরাট কাজে আসবে।
বঙ্গোপসাগরে সামরিক নজরদারি (মিলিটারি সার্ভেল্যান্স) বাড়ানোর ক্ষেত্রেও যে এটি মিয়ানমারকে প্রভূত সাহায্য করবে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।
মিয়ানমারে ইউনিভার্সিটি অব ইয়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সন উইনের কথায়, “পররাষ্ট্র নীতিই হোক বা দেশের স্বরাষ্ট্র নীতি, প্রতিটি দেশকেই নিজের স্বার্থে এগুলো নিয়ে ক্রমাগত কাজ করে যেতে হয়। মিয়ানমারকেও তাই একই জিনিস করতে হবে।”
তিনি আরও বলছিলেন, “ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণেও মিয়ানমারের অবস্থানটা আসলে খুব আকর্ষণীয়।”
“আমাদের উত্তর ও পশ্চিমে যেমন চীন ও ভারতের মতো দুটো বৃহৎ পরা-শক্তি রয়েছে, তেমনি দক্ষিণে ও পূর্বে আমরা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অংশ।”
“ফলে মিয়ানমারের বাজার ধরার জন্য এবং এ দেশের অর্থনীতিতে অংশ হয়ে ওঠার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। আর আগামী দিনে এই পরিস্থিতি চট করে পাল্টাবেও না”, মনে করছেন সন উইন।