ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির ‘কাছে-আসার-গল্পে’ বাংলাদেশের চায়ের আড্ডাগুলো গত কয়েক মাস বেশ মশগুল হয়ে আছে। এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সন্তুষ্টির মোটাদাগে অন্তত দুটি কারণ ঘটে গেছে। আরাকানে দ্রুতবেগে সামরিক নিয়ন্ত্রণ পাল্টাচ্ছে এবং মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু ভারতীয় সৈনিকদের তাঁদের দেশ ছাড়তে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।
রাখাইন জেনারেল থোয়াই ম্রা নাইং এবং প্রকৌশলী মুইজ্জু—উভয়ে বেইজিংয়ের খুব কাছের লোক। তবে ভারত মালদ্বীপের কাছাকাছি সমুদ্রে নতুন করে নৌসেনা মোতায়েন করে ঘটনার বেশ শক্ত এক জবাব দিল। এই মাসে উত্তরাখন্ড ও হিমাচলসংলগ্ন চীনা সীমান্ত লক্ষ্য করেও তারা নতুন করে দশ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মালদ্বীপের ঘটনাবলি পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে আঞ্চলিক ‘মুরব্বিদের’ ঠান্ডাযুদ্ধ ব্যাপকভাবে উসকে দিল। এর পরবর্তী ছাপ পড়বে হয়তো শ্রীলঙ্কার নির্বাচনে। কয়েক মাস পরই যার তারিখ ঘোষিত হওয়ার কথা।
ভারতের ঐতিহাসিক প্রভাব অগ্রাহ্য
আরাকানকে অতীতে আশপাশের যাঁরা মাত্র ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ‘ছোট্ট এক এলাকা’ হিসেবে বিবেচনা করে এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আমলে নেননি, তাঁরা এখন সেখানকার পরিস্থিতি দেখে হতবিহ্বল হচ্ছেন। মালদ্বীপকে নিয়ে চীন-ভারত অবশ্য সে রকম ভুল করেনি।
ভূমি-আয়তন অনুযায়ী বিশ্বের দেশগুলোর তালিকায় মালদ্বীপের অবস্থান ২০৯তম। কেবল ৩০০ বর্গকিলোমিটারের মতো শুকনো জমিন আছে তার। জায়গার হিসাবে এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা নারায়ণগঞ্জেরও অর্ধেক। ভোটারসংখ্যার হিসাবে মালদ্বীপ বাংলাদেশের মাত্র একটা সংসদীয় আসনের সমান গুরুত্ব পেতে পারে। ভারতের তুলনায় এই দেশ ১১ হাজার গুণ এবং চীনের তুলনায় ৩২ হাজার গুণ ছোট। কিন্তু সাগরে এই ছোট্ট দেশটি নিয়ে চীন-ভারতের টানাপোড়েন আবারও জানিয়ে দিল, শক্তিধর দেশগুলোর কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য ভৌগোলিক আকার নয়, অবস্থানই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ রকম গুরুত্ব থেকে ফায়দা তুলতে সাহসী রাজনীতিও লাগে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুকে অবশ্য কেবল সাহসী নয়, দুঃসাহসী মনে হচ্ছে। গত অক্টোবর-নভেম্বরে নির্বাচনে জিতে প্রথমেই তিনি ভারতীয় সৈন্যদের তাঁর দেশ ছাড়তে বললেন। যদিও এটা তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল, কিন্তু অনেকে তখন ভেবেছিলেন বিষয়টা ভালো কোনো দর-কষাকষির ভেতর দিয়ে আপস-মীমাংসা হয়ে যাবে। এ রকম অনুমানের কারণ ছিল।
মালদ্বীপে ভারতীয় প্রভাব বিপুল। অতীতে এখানে কেউ প্রেসিডেন্ট হলে কূটনৈতিক সফরে প্রথম যেতেন নয়াদিল্লি। ছোট্ট এই দেশটিতে ভারতের কূটনৈতিক দপ্তর আছে দুটি। অতীতে দেশটির নানান বিপদে ভারত উদারভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে এবং পর্যটনশিল্পেও ভারতের বড়সড় ভূমিকা ছিল।
কিন্তু মুইজ্জু এসব প্রভাব অগ্রাহ্য করার ঝুঁকি নিয়েছেন। রীতিমতো সময় বেঁধে দিয়ে (১০ মে ২০২৪) ভারতকে সৈন্য সরাতে বাধ্য করলেন তিনি। তাঁর চাপের কাছে নতিস্বীকার করে এরই মধ্যে দ্বীপরাষ্ট্রটি থেকে ভারতীয় সৈন্যরা ফিরতে শুরু করেছে।
নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য এটা বেশ বিব্রতকর হয়েছে। মুইজ্জু এখনো ভারত সফরেও যাননি। আবার সম্প্রতি তাঁর সরকার চীনের সঙ্গে এক সামরিক চুক্তি করেছে। ভারতের দিক থেকে শেষোক্ত ঘটনা বেশ অসহনীয় ঠেকছে। এসবই ঘটল মালদ্বীপের সমাজে গত দু-তিন বছরের ‘ইন্ডিয়া-আউট’ প্রচার আন্দোলনের পরপর। সে সময় দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহামেদ সলিহ এবং ভারতের সঙ্গে তাঁর প্রশাসনের সম্পর্ক ছিল অতি নিবিড়। কিন্তু সলিহর অতিরিক্ত ভারতবান্ধব নীতি মালদ্বীপের সমাজে গভীর এক পাল্টা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
অতঃপর মালে-বেইজিং সামরিক সহযোগিতা চুক্তি
মালে ও বেইজিংয়ের মধ্যে সদ্য হওয়া সামরিক সহায়তা চুক্তিতে কী আছে, এখনো তার বিস্তারিত প্রকাশ করেনি কোনো দেশ। দেশটির আগের প্রশাসনও ভারতের সঙ্গে হওয়া সমঝোতাগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করত না। তবে এবার মোহামেদ মুইজ্জু এটুকু জানিয়েছেন, নতুন চুক্তির মাধ্যমে বেইজিং মালদ্বীপকে বিনা অর্থে ‘প্রাণঘাতী নয়’ এমন অস্ত্র দেবে এবং সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণও।
চুক্তির আগে আগে গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের একটা ‘গবেষণা জাহাজ’ মালে বন্দর ঘুরে গেছে। ভারতের তরফ থেকে এই জাহাজ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে ভারত তার দেশের পর্যটকদের মালদ্বীপ যাওয়াও নিরুৎসাহিত করছে। যেহেতু পর্যটন মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, সে কারণে ভারতের ওই পদক্ষেপ দেশটিতে অর্থনৈতিক আক্রমণের মতোই ছিল।
ইতিমধ্যে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা বেশ কমেও গেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, গত ৩১ ডিসেম্বর বয়কটের শুরুর আগে মালদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকদের হিস্যা ছিল ১১ শতাংশ। চলতি মার্চে সেই হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩ ভাগ। সর্বশেষ হিসাবে মালদ্বীপ ভ্রমণকারীদের সংখ্যায় ভারতীয়দের অবস্থান ষষ্ঠ। অথচ তারা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক নম্বর অবস্থানে ছিল।
তবে ভারতীয়দের মালদ্বীপ আগমন কমে গেলেও চীনাদের সেখানে যাওয়া বেড়েছে এবং সামগ্রিকভাবে মালদ্বীপে পর্যটকদের আসাও বেড়েছে। এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা যায়, আগের বছরের চেয়ে এ সময় ১৬ দশমিক ২ ভাগ পর্যটক বেশি এসেছেন।
বছরের এই প্রথম ৫৫ দিনে গতবার এসেছিলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ জন এবং এবার এসেছেন ৩ লাখ ৭৮ হাজার ২৪৫ জন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন চীন থেকে। এ রকম তথ্য প্রকাশের ঠিক পরপরই চীনের সঙ্গে মালের সামরিক সহযোগিতার বিষয়টা সামনে এল।
উল্লেখ্য, মালদ্বীপের পক্ষ থেকে চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহামেদ ঘাশান মামুন। এই মোমুন হলেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের কনিষ্ঠ পুত্র। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে, যখন বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাত্র আট বছরের এক কিশোর, তামিল ভাড়াটে সৈনিকদের এক অভ্যুত্থানের হাত থেকে তাঁর পিতা প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম সরকারকে রক্ষা করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘অপারেশন ক্যাকটাস’।
সংগত কারণে মালদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের নীতিনির্ধারকদের কাছে নাটকীয় এবং তিক্ত ঠেকছে। ফলে তারাও একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার সঙ্গে মালদ্বীপকেন্দ্রিক উত্তেজনার সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে ভারত মালদ্বীপের কাছাকাছি থাকা লাক্ষাদ্বীপে নিজেদের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এখানকার মিনিকয় দ্বীপে ‘আইএনএস জটায়ু’ নামে নৌঘাঁটি গড়ছে তারা। এই পদক্ষেপের পক্ষে প্রকাশ্য যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ‘জটায়ু’ ভারত মহাসাগরে আন্তর্জাতিক নৌ যোগাযোগের নিরাপত্তা বাড়াবে। তবে অনেকে একে মালদ্বীপ থেকে সৈন্য ফেরত আনতে বাধ্য হওয়ার পাল্টা প্রতিক্রিয়া মনে করছেন। মিনিকয় দ্বীপ মালদ্বীপ থেকে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার দূরে।
চীন সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বাড়াচ্ছে ভারত
ভারতে কাশ্মীরের বাইরে লাক্ষাদ্বীপ হলো একমাত্র মুসলিমপ্রধান এলাকা। ৩০-৪০টি কোরাল দ্বীপ নিয়ে এখানকার জনগোষ্ঠীর আবাস। নৌঘাঁটি স্বাভাবিকভাবে এখানকার এত দিনের জীবনধারা কিছুটা হলেও বদলে দেবে। তবে চীনমুখী কেবল এই পদক্ষেপ নিয়েই বসে নেই ভারত। মালে-বেইজিং ‘সামরিক সহযোগিতার’ ঘোষণার পরপর ভারতের তরফ থেকে তার পশ্চিম সীমান্তে নতুন করে ১০ হাজার সৈন্য মোতায়েনের ঘোষণা এসেছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার ৮ মার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী নতুন করে মোতায়েন করা সৈনিকেরা হবে ইতিমধ্যে সেখানে থাকা ৯ হাজার জওয়ানের অতিরিক্ত। ভারত এভাবে সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ করার কারণ হিসেবে চীনের পক্ষ থেকে সীমান্ত বিষয়ে ‘লিখিত চুক্তির’ বরখেলাপের কথা বলছে। জাপান সফররত অবস্থায় তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সে রকমই বললেন।
লাক্ষাদ্বীপে নৌ স্থাপনা এবং সীমান্তে সৈন্য বাড়ানোর পাশাপাশি কেরালার কোচিনে ৬ মার্চ আমেরিকার তৈরি ছয়টি সি-হক হেলিকপ্টারের একটা স্কোয়াড্রনও মোতায়েন করেছে ভারত (হিন্দুস্তান টাইমস, ৩ মার্চ ২০২৪)।
চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড-মার্টিন থেকে এ রকম ২৪টি হেলিকপ্টার কেনার জন্য ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি করেছিল নয়াদিল্লি। সাবমেরিনবিরোধী যুদ্ধে সি-হককে একটা কার্যকর যুদ্ধাস্ত্র মনে করা হয়।
মালদ্বীপকে ঘিরে ভারত ও চীনের এ রকম পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ সামনে হয়তো আর বাড়বে। তবে অনেক ভাষ্যকারের কাছে উদ্বেগের বিষয় হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের এ রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছাপ পড়তে পারে। যেমনটি পড়েছে মালদ্বীপের ভেতর।
প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে যেভাবে পরিচালনা করছেন, তাতে দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা মোহামেদ নাশিদ ইতিমধ্যে আপত্তি তুলেছেন। নাশিদ দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্টও বটে। বোঝা যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন নিয়ে মালদ্বীপের রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে।
সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র ব্যবসা কি বাড়বে
মালদ্বীপের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট অন্যান্য দেশের সমাজেও যে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের ছাপ পড়ছে, সেটা এখন আর পর্দার আড়ালের বিষয় থাকছে না। এতে জনজীবনের স্থানীয় প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে এসব দেশের জনসমাজ অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে সামরিক ব্যয় বাড়ার আলামতও দেখা যাচ্ছে।
যুদ্ধাস্ত্রের খরচ বাড়ামাত্রই অনিবার্যভাবে বেসামরিক খাতগুলোতে বরাদ্দ কমতে থাকবে। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপকেন্দ্রিক উত্তেজনা আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্যও একটা ‘সুসংবাদ’। মিয়ানমারের কোচিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিক্রি হয়ে আসা হেলিকপ্টারবহরের উপস্থিতিও তেমনটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
- আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- সূত্র : প্রথম আলো