শেখ রোকন : বাংলা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ প্রবাদের যেন সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে মালদ্বীপে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় রাউন্ড নির্বাচনে ৫৪ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে বিরোধী দল পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের (পিএনএস) প্রার্থী মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ‘চীনপন্থি’ হিসেবে পরিচিত; যেমন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ পরিচিত ছিলেন ‘ভারতপন্থি’ হিসেবে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং ভৌগোলিক নৈকট্য বিবেচনায় ভারত যদি মালদ্বীপের ‘কুল’ হয়; বিপুল বিনিয়োগ ও অনুদান নিয়ে এগিয়ে আসা চীন তাহলে ‘শ্যাম’।
ভারতের কথা ভিন্ন। মালদ্বীপের স্বাধীনতার পর প্রথম যে রাষ্ট্র দূতাবাস খোলে, সেটা ভারত। প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম যে চার দশক মালদ্বীপ শাসন করেছেন, এর নেপথ্যে ছিল ভারতের আশীর্বাদ। এমনকি ১৯৮৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হলে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেটাকে ছত্রভঙ্গ করেছিল নয়াদিল্লিই। সংকটময় মুহূর্তে ‘হস্তক্ষেপ’ ছাড়া বাকি সময় বাণিজ্য সহায়তা এবং দুর্যোগকালে ত্রাণ তৎপরতার এই ধারা মামুনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ নাশিদের শাসনামল পর্যন্ত বজায় ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুরু হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। মালেতে ‘চীনপন্থি’ আব্দুল্লাহ ইয়ামিন ক্ষমতায় এলে নয়াদিল্লি নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। ততদিনে ভারত মহাসাগরীয় স্রোত অনেক দূর গড়িয়েছে।
ইয়ামিন ক্ষমতায় এসেই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগদান ছাড়াও চীন-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। চীনা অর্থায়নে প্রথমবারের মতো হালহালে দ্বীপে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ে এবং দ্বীপটির সঙ্গে ‘রাজধানী দ্বীপ’ মালের সেতু সংযোগ নির্মিত হয়। আরও নানা প্রকল্প মিলিয়ে ২০১৮ সাল নাগাদ মালদ্বীপে চীনা ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের অঙ্ক দাঁড়ায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। মাত্র ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপির দেশে দেড় বিলিয়ন ডলারের ‘বন্ধুত্ব’ চাট্টিখানি কথা নয়!
বিস্তৃত ভারত মহাসাগরে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের মূল গুরুত্ব ভূরাজনৈতিক। এর অবস্থান এমন স্থানে, যেখান দিয়ে বিশ্বের ব্যস্ততম পূর্ব-পশ্চিম সমুদ্রপথ অবস্থিত। এর নিয়ন্ত্রণ মানে কেবল বাণিজ্য নয়, কৌশলগত প্রভাবেরও প্রশ্ন। যেমন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় যে ‘সামুদ্রিক সিল্ক রুট’ নির্ধারণ করা হয়েছে, এর চারটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে চারটি দ্বীপরাষ্ট্র: শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সিসিলি ও মরিশাস। এ ছাড়া ভারত ঘিরে যে ‘মুক্তোর মালা’ গাঁথার পরিকল্পনা চীন নিয়েছে, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার পর মালদ্বীপও সেই মালার গুরুত্বপূর্ণ রত্ন।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের নির্বাচনে আব্দুল্লাহ ইয়ামিন পরাজিত হয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জঙ্গিবাদ লালন, বিরোধী মত দমনের দায়ে কারাগারে যান। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, মালদ্বীপের ঐতিহাসিকভাবে ‘পশ্চিমমুখী’ পররাষ্ট্রনীতিকে ‘পূর্বমুখী’ করতে যাওয়ার মূল্য চুকাতে হয়েছে তাঁকে। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসেই মোহাম্মদ ইব্রাহিম সলিহ ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। ভারতও বুঝতে পারে যে, শ্যাম যখন টাকার থলি নিয়ে নেমেছে, তখন শুধু কথায় কুল রক্ষা হবে না। নয়াদিল্লি দ্রুতই ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান অনুমোদন করে মালের জন্য। তারাও আরেকটি দ্বীপ সংযোগকারী সেতু, সমুদ্রবন্দর, ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ করে। মালেভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘বানী’ হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যেই মালদ্বীপে ভারত ও চীনের ‘বিনিয়োগ’ কাঁটায় কাঁটায় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির মোট জিডিপির ২৬ শতাংশ করে।
এর মধ্যেই ক্ষমতায় এলেন ‘চীনপন্থি’ মোহাম্মদ মুইজ্জু। তাঁর ক্ষমতায় আসার নেপথ্যে কি শুধুই ভারত ও চীনের বিরোধ? মালদ্বীপ সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা বলছেন, ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এলেও তিনি একই পথে হেঁটেছেন। দেশের সাধারণ মানুষ সেটা ভালোভাবে নেয়নি। ভোটের বাক্সে পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মালদ্বীপের এই ‘পররাষ্ট্র প্রভাবিত নির্বাচন’ বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা বহন করে? সার্কভুক্ত দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রাচীন। মালদ্বীপ সরকারের হিসাব অনুসারে, সেখানে কর্মরত ১ লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশির কথাও ভাবতে হবে। হাতেগোনা যে কয়টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি নেই, বরং উদ্বৃত্ত, মালদ্বীপ তার একটি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মালদ্বীপ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩টি সামরিক যান উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে এক প্রকার প্রতিরক্ষা সম্পর্কেরও সূচনা করেছেন। কিন্তু মালদ্বীপের নির্বাচনে বাংলাদেশের জন্য মূল বার্তা দুটি। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তাই মূল। যদি জনসাধারণের সমর্থন না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী পক্ষগুলোর খুব বেশি কিছু করার থাকে না। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এতটা মাখামাখি করতে নেই, যেটা কূটনীতি ও অর্থনীতি ছাপিয়ে দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। বন্ধুত্ব বৈঠকখানা পর্যন্তই রাখতে হয়; শয়নকক্ষে আনতে হয় না।
শেখ রোকন: লেখক ও গবেষক; সহযোগী সম্পাদক ।
সূত্র : সমকাল