দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। একসময় বিত্তবানরা কেনাকাটা করতে শহরের মার্কেটে ছুটে যেতেন। অতি সামর্থ্যবানরা ছুটে যেতেন বিদেশে। তবে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ায় মানুষ কেনাকাটায় ঝুঁকছে। ফলে চাহিদা বাড়ায় দেশে মার্কেট ও শপিংমল বাড়ছে। বর্তমানে শুধু রাজধানী নয়, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও গড়ে উঠেছে মার্কেট ও শপিংমল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব মার্কেট ও শপিংমলে অনেকে দোকান কিনে ভাড়া দেন। আবার অনেকেই নিজেরাই কিনে ব্যবসা করেন। তবে এসব মার্কেট ও শপিংমলের দোকান কিনতে খরচ হয় লাখ ও কোটি টাকা। এসব মার্কেট ও শপিংমলে বিক্রি হয় কোটি কোটি টাকা। কিন্তু এসব দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আয়কর পায় না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর এসব দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীদের করজালে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতিটি মার্কেট ও শপিংমলে ব্যবসায়ীদের অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠন রয়েছে। নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, এসব অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনকে বাধ্যতামূলকভাবে ই-টিআইএন নিয়ে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। একইসঙ্গে এসব সংগঠনের সদস্যদেরও ই-টিআইএন নিয়ে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এসব সংগঠন ও সংগঠনের সদস্যদের ই-টিআইএন ও রিটার্ন যাচাই করতে কর অঞ্চলগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। একইসঙ্গে বিভিন্ন আমদানি, রপ্তানি ও সরবরাহকারী ৪০১টি অ্যাসোসিয়েশন, ৮৩টি চেম্বার ও তাদের সদস্যদের ই-টিআইএন, রিটার্ন যাচাই করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এনবিআর থেকে কর অঞ্চলগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ নতুন করদাতা করের আওতায় আসবে বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
এনবিআর সূত্রমতে, ২৩ নভেম্বর সব কর অঞ্চলকে এনবিআর চিঠি দিয়েছে। দ্বিতীয় সচিব (জরীপ, করফাঁকি ও আইটিপি রেজি.) মীর মো. আরিফ হোসেন সই করা চিঠি দেয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, ‘আয়কর আইন, ২০২৩’ অনুযায়ী কোম্পানির সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক সংগঠন, চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের টিআইএন, আয়কর রিটার্ন দাখিল ও পিএসআর এর আইনগত বাধ্যবাধকতা পরিপালন নিশ্চিতকরণ ও করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এর আগে ৫ অক্টোবর একই ধরনের চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে কর অঞ্চল ও কমিশনারদের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ২(৩১)(ঙ) অনুযায়ী, ‘যে কোনো শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন, ফাউন্ডেশন, সমিতি, সমবায় সমিতি এবং যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’কে কোম্পানি হিসাবে (কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ ১৯৯৪ সালের ১৮নং আইন) সংজ্ঞায়িত করা হইয়াছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি কর অঞ্চলের অধিক্ষেত্রাধীন এলাকার প্রতিটি ব্যবসায়িক অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বার এবং এসব সংগঠনের সদস্যদের টিআইএন থাকবে। এছাড়া এসব সংগঠন ও সদস্যদের পক্ষে যথাসময়ে যথানিয়মে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৬৪(১১) অনুযায়ী, ‘ট্রেড বডি বা পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ প্রাপ্তি ও বহাল রাখতে’ আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক (পিএসআর) উপস্থাপন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি এনবিআর দেশের সব চেম্বার থেকে নেয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, অধিকাংশ চেম্বারের তথা ট্রেড বডির, এমনকি তাদের অন্তর্ভুক্ত অনেক সদস্য আদৌ টিআইএন নেই। যাদের টিআইএন রয়েছে, তাদের অনেকেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না, যা আয়কর আইন, ২০২৩-এর সরাসরি লঙ্ঘন।
কর অঞ্চলকে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি কর অঞ্চলের অধিক্ষেত্রাধীন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের এবং এসব সংগঠনভুক্ত সব সদস্যের টিআইএন গ্রহণ, আয়কর রিটার্ন দাখিল ও দাখিল করা আয়কর রিটার্ন মোতাবেক আয়কর পরিশোধের বিষয়টি তদারকিকরণসহ আয়কর আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। উল্লেখ্য, চিঠির সঙ্গে এফবিসিসিআই’র ভোটারের প্রকার, শিল্প ও বাণিজ্যিক সংগঠনের কর সার্কেলভিত্তিক তালিকা দেয়া হয়েছে। কার্যক্রম গ্রহণ করে তার তালিকা এনবিআরে পাঠাতে কর অঞ্চলগুলো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে গড়ে উঠেছে কলকারখানা। আয় বাড়ায় মানুষের চাহিদা বেড়েছে। সেজন্য বিভাগীয় শহর, জেলা উপজেলা এমনকি উপজেলায় পর্যায়েও গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দোকান, মার্কেট, বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেট ও শপিংমল। প্রতিটি মার্কেট ও শপিংমলে শত শত দোকান ও শোরুম রয়েছে। প্রতিটি মার্কেট ও শপিংমলে কোটি কোটি টাকা যেমন বিনিয়োগ হচ্ছে, তেমনি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। এসব মার্কেট ও শপিংমলে অনেকে নিজে দোকান কিনে নিজেই ব্যবসা করেন। আবার অনেকেই দোকান কিনে ভাড়া দিয়েছেন। এসব মালিক ও ব্যবসায়ীকে করের আওতায় আনতে পারছে না এনবিআর। কারণ অনেকের ই-টিআইএন নেই।
যাদের ই-টিআইএন রয়েছে, তাদের অনেকেই আয়কর রিটার্ন দেয় না। আর যারা রিটার্ন দেয়, এসব মার্কেট ও শপিংমলে দোকানে বিনিয়োগ, বিক্রি কিছুই রিটার্নে দেখায় না। ফলে এসব মার্কেট ও শপিংমলের ব্যবসায়ী, মালিকদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না। তবে এসব মার্কেট ও শপিংমলের মালিক ও ব্যবসায়ীদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। প্রতিটি মার্কেট, শপিংমলে ব্যবসায়ীদের অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠন রয়েছে। প্রতিটি অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনকে আইন অনুযায়ী ই-টিআইএন নিতে হবে, দিতে হবে রিটার্ন। একইসঙ্গে মার্কেট, শপিংমলের অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের ই-টিআইএন নিতে হবে, দিতে হবে রিটার্ন। প্রতিটি অ্যাসোসিয়েশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের ই-টিআইএন গ্রহণ ও রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে কর অঞ্চলগুলোকে চিঠিতে নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। এনবিআর থেকে দেয়া তালিকা অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানাতে বলা হয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, কর অঞ্চলগুলোকে এনবিআর থেকে দেয়া তালিকা অনুযায়ী তিন ধরনের ছকে তথ্য দিতে বলা হয়েছে। প্রথম ছকে কর অঞ্চলের অধিক্ষেত্রাধীন অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের ই-টিআইএন-সংক্রান্ত পৃথক তথ্য দিতে হবে। অ্যাসোসিয়েশন বা চেম্বারের নাম ও ঠিকানা, ই-টিআইএন নেয়ার তারিখ, অ্যাসোসিয়েশন বা চেম্বারের মোট সদস্যসংখ্যা, আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে কিনা। একইভাবে দ্বিতীয় ছকে অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের সদস্যদের ই-টিআইএন-সংক্রান্ত তথ্য দিতে হবে। অ্যাসোসিয়েশন বা চেম্বারের নাম ও ঠিকানা, সদস্যদের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা, ই-টিআইএন, জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-টিআইএন নেয়ার তারিখ, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল করেছেন কিনা। তৃতীয় ছকে অন্যান্য অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বার এবং তাদের সদস্যদেরও একইভাবে ই-টিআইএন, রিটার্ন দাখিল-সংক্রান্ত তথ্য দিতে বলা হয়েছে। কোনো অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার এবং এসব অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের কোনো সদস্য ই-টিআইএন গ্রহণ না করা ও রিটার্ন দাখিল না করলেও তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, এনবিআর থেকে কর অঞ্চলগুলোকে দেয়া চিঠির সঙ্গে ৪০১টি অ্যাসোসিয়েশন ও ৮৩টি চেম্বারের তালিকা দেয়া হয়েছে। এসব অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার কোন কোন কর অঞ্চল ও সার্কেলের অধিক্ষেত্রাধীন, তাও তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুসারে, মহানগরসহ সারাদেশে দোকান মালিক আছেন ৭০ থেকে ৭৫ লাখ বাংলাদেশ। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বড় বড় দোকান-ব্যবসায়ী আছেন ছয় থেকে সাত লাখ, যাদের অধিকাংশেরই দিনে লেনদেন লাখ টাকার বেশি। খুলনায় আছেন দুই লাখের বেশি, রাজশাহীতে এক লাখ, চট্টগ্রামে চার লাখ। এ ছাড়া, জেলা শহরগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার দোকান-ব্যবসায়ী আছেন। কোনো কোনো উপজেলায় দোকান-ব্যবসায়ী আছেন এক হাজার থেকে ১০ হাজার।
শেয়ার বিজ