যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল এমন সময় বাংলাদেশ সফরে এল, যখন মিয়ানমারের সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা–ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তার নিরিখে ভূরাজনীতির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
গত দুই দিনে ঢাকায় সফরকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। দুই দেশই সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চায়।
বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি ও কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরকে ‘নির্বাচন–পরবর্তী বোঝাপড়ার’ প্রতিফলন হিসেবে দেখতে চাইছেন। তাঁরা এই সফরকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এলিন লাউবাকের। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও বিশেষ সহকারী। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউসের অধীন এনএসসি মূলত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার পটভূমিকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে থাকে।
গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে আলোচনার পর এলিন লাউবাকের সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে এসে দুই দেশের অভিন্ন অগ্রাধিকার নিয়ে কথা বলাটা আনন্দের। ভবিষ্যতে কীভাবে একে অন্যকে সহায়তা করব, তা নিয়ে কথা বলেছি। বাংলাদেশের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু নির্বাচনের মতো একটি ইস্যুতে নিজেদের ‘ভিন্নমতের’ বিষয়টি সামনে না রেখে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে যুক্ততায় জোর দিয়েছে। বিশেষ করে শনি–রোববার সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধির পাশাপাশি নানা মহলের সঙ্গে মতবিনিময় করে যুক্তরাষ্ট্র এটা স্পষ্ট করেছে যে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে নানা পক্ষের সম্পৃক্ততা জরুরি।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার গত শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। একই দিন তিনি ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার শ্রমিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
পরদিন রোববার যুক্তরাষ্ট্রের এই জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তা নাগরিক সমাজের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রাতরাশসভা করেন। এরপর প্রতিনিধিদলটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এলিন লাউবাকেরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরে রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি ব্যবসার সংস্কারবিষয়ক এক সেমিনারে অংশ নেয়। রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রতিনিধিদলটি।
পরে সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সামনের দিনগুলোয় কীভাবে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর করা যায়, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন এখন পেছনের ঘটনা। সেটা নিয়ে তাঁরা কোনো কথা বলেননি, আমরাও বলিনি।
মার্কিন প্রতিনিধিদল মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান আরও বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর তারা নজর রাখছে। সেই সঙ্গে আমাদেরও নজর রাখতে বলেছে।
প্রসঙ্গ বাইডেনের চিঠি
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গত রোববারের আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠির প্রসঙ্গ এনেছেন। ওই চিঠি নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের অস্বস্তি কাটিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত বলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সফরকারী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ের আলোচনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক পদক্ষেপ, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনের কিছু বক্তব্য ও নির্বাচনের পর ওয়াশিংটনের বক্তব্যের প্রসঙ্গটিও এসেছে। বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসা নীতি এবং বাংলাদেশের দিক থেকে নানা বক্তব্য আর যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিফিংয়ে দেওয়া বক্তব্যগুলো আলোচনায় আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা বাইডেনের চিঠির পর এই সফর দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ভিসা নীতি বিবেচনাসহ আরও পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে নেবে, এমনটা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ মার্কিন প্রতিনিধিদলের এ সফরকে রাজনৈতিক পটভূমি থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে বিস্তৃত পরিসর থেকে দেখে যুক্তরাষ্ট্র। তারা নির্বাচন নিয়ে দ্বিমত থাকার পরও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলসহ ভূরাজনীতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ সহকারীকে ঢাকায় পাঠিয়ে হোয়াইট হাউস সেই বার্তাই দিচ্ছে।
মিয়ানমার পরিস্থিতি
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু সম্প্রতি ওয়াশিংটনে এক আলোচনায় মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক থাকতে বলে মূলত রাখাইন ও চীনের ওপর যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দৃষ্টি রাখছে, সে বার্তাই দিয়েছেন।
গত সোমবার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বিএনপি ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি পর্যায়ে আলোচনার সময় রাখাইনে সংঘাতের কারণে ভারতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ছয় শ সদস্য এবং বাংলাদেশে ৩৩০ জনের অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গটি আসে। এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা তৈরি হয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় বিচ্ছিন্নবাদীদের অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরির ঝুঁকি আছে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকদের একাংশের মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের নানা মহলের অবস্থানটা অভিন্ন নয়। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর সুশাসন, মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধের বিষয়গুলোতে চাপ দিলেও হোয়াইট হাউসের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন বলে কূটনীতিকদের একটি অংশের মত। তাঁরা মনে করেন, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, সেটি থামাতে গেলে বাংলাদেশের মতো বন্ধুদেশকে চটানো সমীচীন নয় বলে হোয়াইট হাউসের মত।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যে মতপার্থক্য রয়েছে, সেটা পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টাও যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এই সফর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যখন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তখন বলা যায়, নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের ওপর বিশেষ নজর রাখছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে মিলে বিষয়টি বোঝা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো