মার্কিন নিষেধাজ্ঞা: দায় অনেকাংশেই সরকারের

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা: দায় অনেকাংশেই সরকারের

আমাদের সাবেক একজন সেনাপ্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় আবার নতুন অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন। উল্লেখ্য, তাঁকে নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা ও বিতর্ক চলছিল। তিনি ২০২১ সালের জুনে অবসরে গেছেন। এর তিন বছর পর দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা এল। সাবেক সেনাপ্রধানদের মধ্যে তিনিই প্রথম এ-জাতীয় কোনো নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছেন।

এর আগে ২০২১ সালে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও এর কর্মরত ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের। তবে সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, এই কর্মকর্তা উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান দুটি অভিযোগের একটি হলো তিনি তাঁর ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহায়তা করেছেন। তা করতে গিয়ে তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ রয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে তিনি তাঁর ভাইকে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করতে অন্যায্যভাবে কাজ করেছেন। অভিযোগের বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি অবাক ও মর্মাহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। তিনি আরও বলেছেন, অভিযোগগুলো সত্য নয়। সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁর দুই ভাইয়ের একজনকে ক্ষমা করা হয়েছিল তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার আগে। আরেকজনকে এরপর। এগুলোর সঙ্গে তাঁর পদ ব্যবহার করার কোনো সুযোগ ছিল না মর্মেও উল্লেখ করেছেন। তবে এমনটা বলেছেন, এ ধরনের অভিযোগ সরকারকেও কিছুটা বিব্রত ও হেয় করে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না দেওয়া হলেও একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাঁদের বিবেচনায় এতে সরকার বা সরকারি দলের বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হচ্ছে না যে অভিযোগে বর্ণিত কোনো ঘটনা ঘটেনি। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যথাক্রমে প্রায় চার ও তিন বছর বিজিবি ও সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক ভাইকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অপর দুই ভাইয়ের সাজা মওকুফ করেছিল সরকার। এটা সত্য, এ ধরনের মুক্তিসংক্রান্ত কার্যক্রম কোনোটিই সেনাপ্রধান বা বিজিবি প্রধানের আওতায় নেই। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেন সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে। আর সরকার তা করতে পারে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণে। এগুলোর সাংবিধানিক বা আইনি দিক নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও নৈতিক দিক নিয়ে প্রশ্ন ছিল এবং থেকেই যাবে। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রয়োগ এর বাইরে হতে পারে না। এ ধরনের সাংবিধানিক ও আইনি বিধান শুধু প্রয়োগ করতে হবে জনস্বার্থে। এখানে সরকারের অবস্থান অস্পষ্ট ও দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইচ্ছেমতো, দণ্ডিত কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমা বা সাজা মওকুফ করতে এ ধরনের বিধান সংবিধান কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধিতে এর প্রণেতারা সংযোজন করেননি।

আরও অভিযোগ রয়েছে, তাঁর দুই ভাই অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। সরকারের প্রভাবশালী মহলের দৃঢ় ও নিশ্চিত সমর্থন ছাড়া এমনটা করা যায় না। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচিতি গোপন করা কোনো সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ নয়। সেগুলো কেন, কীভাবে আর কাদের সংশ্লিষ্টতায় করা হয়েছে, এ নিয়েও সরকার নীরব। সামরিক কন্ট্রাক্ট নিয়ে বিস্তারিত না জেনে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে সেই সেনাপ্রধানের পরিবারের একাধিক নিকটজন অপরাধমূলক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট হয়ে সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। এ ধরনের অতীত নিয়ে তিনি কীভাবে বিজিবি প্রধানের বা পরে সেনাপ্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিয়োগ পেতে পারেন, এটা নিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি হয়। সরকারের ছোটখাটো একটি চাকরি পেতেও তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচিতি, এমনকি হাল আমলে রাজনৈতিক পরিচিতি গুরুত্বের সঙ্গে তলিয়ে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে বলা চলে সরকার জেনেশুনেই তাঁকে এ ধরনের পদে নিয়োগ দিয়েছিল। সুতরাং এটা যথার্থ যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ ধরনের একটি ব্যবস্থা সরকারকে বিব্রত ও হেয় করেছে।

সরকারের এ ধরনের ভূমিকার দায় অংশত গিয়ে পড়ে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তির ওপরও। অথচ তারা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী। সময়-সময় আইনশৃঙ্খলার মোকাবিলায়, জাতীয় দুর্যোগ, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় এ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এর কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা আমরা প্রশংসার সঙ্গে লক্ষ করি। মূলত এদের ওপর ভিত্তি করেই র‍্যাব নামক প্রতিষ্ঠান জনমনে চমক সৃষ্টিকারী অবদান রাখে। জঙ্গিদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য এটি একটি দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দায়বদ্ধতার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ কাজে এদের কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছেন। এ ধরনের একটি বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। এদের ক্ষিপ্রতা ও চৌকস নজরদারি দেশে এমন বিশেষ বিশেষ অপরাধ উন্মোচনে সাফল্যের ছাপ রেখেছে।

বলা চলে, সেনাবাহিনীর কোনো দিক দিয়ে বিতর্কিত হওয়া দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। অবশ্য উল্লেখ করতে হবে সরকার এ দেশের নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠানেরই ধারভার কমিয়ে ফেলেছে। এমনটি ঘটছে পছন্দের নিয়োগ, দলীয়করণ ও সব সংস্থাকে সরকারি দলের সমান্তরাল অবস্থানে নেওয়ার ফলে। মানুষ আস্থা স্থাপন করতে পারে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এখন দেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

এসব বিষয়ে বহু বক্তব্য এলেও সরকার নীরব থাকা বা অবজ্ঞা করার নীতি নিয়েছে। প্রসঙ্গত, পুলিশের সাবেক আইজিপির নামে-বেনামে বিশাল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে একটি বাংলা দৈনিকে বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এসেছিল কয়েক দিন আগে। তিনি এসব বিষয় অসত্য বলে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। এরপর দুদকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে ২০২৪) ঢাকার একটি আদালত সাবেক আইজিপি, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নামে স্থাবর সম্পদ জব্দের (ক্রোক) এবং তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন। আদালতের আদেশের পর দুদক সাবেক আইজিপি ও তাঁর পরিবারের সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

এ বিষয়টির আইনগত দায়িত্ব দুদকের। তবে এ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তারা কতটুকু অগ্রসর হতে পারবে, এ বিষয়ে অনেকেই গুরুতর সংশয়বাদী। সংশয়বাদীদের দোষও দেওয়া যাবে না। কেননা, সাধারণত এ দেশে প্রকৃত ক্ষমতাধরেরা সব ধরনের অনাচার করেও আইনের কাছে অধরা থেকে যাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, এ ঘটনা জনগণের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তেমনি গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সংস্থাটির ভাবমূর্তি। যত বিতর্কই থাকুক, পৃথিবীর সব দেশের মতো আমাদেরও পুলিশ দরকার। উল্লেখ করা অসংগত নয় যে সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এর চিড় ধরা ভাবমূর্তি আরও বিপন্ন করেছে।

এসব ব্যাপার ছাড়াও সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা কোনো বা কোনো ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতির মাঝে চলেছেন। একজন সাবেক মন্ত্রীর বিদেশে প্রভূত সম্পদ থাকার তথ্য গত নির্বাচনকালে টিআইবি সূত্রে পাওয়া যায়। এ সম্পদ সম্পর্কে তিনি তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় হলফনামায় গোপন করেছেন। সংশ্লিষ্ট সাবেক মন্ত্রী বললেন, এগুলো তাঁর পরিবারের এবং বিদেশে অর্জিত সম্পদ। তাঁর মতে, হলফনামায় এগুলো দেওয়ার আবশ্যকতা নেই। নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি উপেক্ষাই করল। সরকার নিল নীরবতার নীতি। এতে আইনকানুনের ওপর মানুষের আস্থা কেন থাকবে? এভাবে আমরা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নিজদের ভাবমূর্তি শোচনীয়ভাবে নিম্নমুখী করছি।

prothom alo