নিজস্ব প্রতিবেদক
bonikbarta.net আগস্ট ১০, ২০২৩
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীদের একজন ইকবাল হোসেন (প্রকৃত নাম নয়)। দেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে শীর্ষস্থানীয় গ্রুপগুলোর একটির স্বত্বাধিকারী তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোয় বছরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেন তিনি। ব্যাংক, আবাসনসহ অন্যান্য খাতেও রয়েছে তার বড় বিনিয়োগ। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে একাধিক বাড়িসহ জমা করেছেন বিপুল সম্পদ। তবে মার্কিন বিধিনিষেধের আওতায় পড়ার আশঙ্কায় বেশ উদ্বিগ্ন এ ব্যবসায়ী। এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছেন, মার্কিন ভিসানীতি কিংবা বিধিনিষেধের আওতাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে তারও নাম রয়েছে কিনা?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারঘনিষ্ঠ ইকবাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মার্কিন সরকার বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। বড় ব্যবসায়ীদের অনেকে আমাকে ফোন দিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আতঙ্কজনক সংবাদও দিচ্ছেন। বুঝতে পারছি না শেষ পর্যন্ত কী হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাশিয়া কিংবা ইরানের ব্যবসায়ীরা হয়তো চলতে পারছেন কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব নয়। কেননা আমাদের রফতানি পণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।’
আতঙ্কের শুরু হয় বাংলাদেশীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর পরই। তবে ওই ঘোষণার প্রতিফলন মূলত সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি কর্মী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমনবিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউর সফর ও মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সম্পদ জব্দের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মূলত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যেই এ আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে বেশি।
মনোভাব যাচাই করতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে বিভিন্ন খাতের প্রায় একডজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের আতঙ্ক ছড়িয়েছে সে বিষয় তাদের প্রায় সবাই নিশ্চিত করেছেন। তারা বলছেন, বিদেশে বড় এক ব্যবসায়ীর সম্পদ গড়া নিয়ে সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ওই ঘটনার আগে থেকেই বড় কয়েকজন ব্যবসায়ী দুই-একটি দেশে ঢুকতে না পারারও গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। তা খুব একটা আমলে না নিলেও পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমনবিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউর বাংলাদেশ সফরের সময় দেয়া নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের ইঙ্গিতের পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করা এক সংগঠনের নেতা জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোয় বহু মার্কিন প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে দুর্নীতি দমনবিষয়ক কোনো সমন্বয়কের বাংলাদেশ সফরের ঘটনা সাম্প্রতিককালে ঘটেনি। সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে রিচার্ড নেফিউ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে অভিযুক্ত কয়েকজনের নামও জানিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। মার্কিন প্রতিনিধিরা দেখতে চাইছেন যে তাদের বিষয়ে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ গড়া ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক অমূলক নয়।
আবার গণমাধ্যমের কাছে নিষেধাজ্ঞাকে দুর্নীতি দমনের একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছেন রিচার্ড নেফিউ। এক সাক্ষাৎকারে সম্পদ জব্দের বিষয়েও উল্লেখ করেছেন তিনি। একই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যেও।
রিচার্ড নেফিউ ও পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘রিচার্ড নেফিউ একসময় নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক অফিসার ছিলেন। তিনি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে বলেননি। কিন্তু বলেছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিষেধাজ্ঞা একটি “অস্ত্র” এবং এটি চিন্তাভাবনা আছে হয়তো।’
গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে রিচার্ড নেফিউ জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা আছে। গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি কর্মসূচির আওতায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যারা দুর্নীতি করেছেন এবং যারা অর্থ পাচারে সহায়তার মাধ্যমে কার্যত দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও এটি অতীতে ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র এ প্রক্রিয়া ব্যবহার করবে।
এদিকে গত ৮ আগস্ট মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যেও সম্পদ জব্দের বিষয়টি ওঠে। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি দমনে কেবল নিষেধাজ্ঞাই নয়, পাচারকৃত সম্পদ জব্দ করার কৌশল নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি যেসব দেশে সম্পদ পাচার হয়েছে, সেই দেশগুলোকে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা হবে, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ এবং তাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের নিরপেক্ষভাবে নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ দিচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে এমন সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছে বণিক বার্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তাদের একজন বলছেন, ‘কতিপয় ব্যবসায়ী আছেন যারা সরকারের আনুকূল্য দেখিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা আদায় করেছেন। সুযোগসন্ধানী ওইসব অসাধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপচারিতায়ও দেখা যায় তারা বেশ উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগের যৌক্তিকতা রয়েছে। যতদূর জানতে পেরেছি বড় বেশকিছু ব্যবসায়ীর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ হতে পারে। তবে সরকারকে চাপে ফেলার ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে বলে মনে করি।’
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের প্রভাব পড়েছে দেশের শেয়ারবাজারেও। গত বছরের ১৩ নভেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ৩০৫ পয়েন্ট। এরপর সূচকটি নেমে যায় ৬ হাজার ২০০ পয়েন্টের ঘরে। এ বছরের ২৩ মে ডিএসইএক্স ৬ হাজার ৩০৬ পয়েন্টে পৌঁছায়। ওই সময়ে এক্সচেঞ্জটির দৈনিক লেনদেনও হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মাঝেমধ্যে উত্থান-পতন দেখা গেলেও পুঁজিবাজারে কিছুটা প্রাণসঞ্চার দেখা গেছে। তবে চলতি মাসের শুরু থেকেই ছন্দপতন শুরু হয়। সূচকের পাশাপাশি এ সময়ে ৪০০ কোটি টাকার নিচে নেমে যায় ডিএসইর দৈনিক লেনদেন। সর্বশেষ গতকাল ডিএসইএক্স সূচক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৯৭ পয়েন্টে। এদিন এক্সচেঞ্জটিতে ৪১৯ কোটি টাকার সিকিউরিটিজ লেনদেন হয়েছে।
দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকটেরও প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে এমন গুঞ্জনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কারণ তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা বা পরিচালকের ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে সেক্ষেত্রে ওই কোম্পানির ব্যবসায়িক ও আর্থিক অবস্থার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পুঁজিবাজার অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে এখানে যেকোনো নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক খবরের প্রভাব সবার আগে পড়ে। বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব বাজারকেও অনেকাংশে প্রভাবিত করে।
জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শরীফ আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কভিড কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হওয়ার আগেই পুঁজিবাজারে এগুলোর প্রভাব সবার আগে দেখা গেছে। পুঁজিবাজার অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি জায়গা। এখানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই এ-সংক্রান্ত গুঞ্জন ও সম্ভাবনা বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করে থাকে, যা সার্বিকভাবে বাজারকেও প্রভাবিত করে। বিভিন্ন শেয়ারে বিনিয়োগ আটকে থাকার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশেরই নতুন করে বিনিয়োগ সক্ষমতা সংকুচিত হয়ে এসেছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ ছিল না। আরেক শ্রেণীর বিনিয়োগকারী যাদের কাছে অর্থ রয়েছে কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিনিয়োগের জন্য তাদের কাছে অনুকূল মনে না হওয়ায় দূর থেকে বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন।’
একক বাজার হিসেবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বাণিজ্য বিভাগের অধীন অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটিইএক্সএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশটি বাংলাদেশ থেকে ৩৮২ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৬৮০ ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৫০০ কোটি ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৩৭১ ডলার। এ হিসাবে জানুয়ারি-জুনে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি কমেছে ২৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
পোশাক রফতানির সবচেয়ে বড় গন্তব্যে রফতানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রম ইস্যুতেও নতুন ধরনের মার্কিন বিধিনিষেধ আরোপের আতঙ্ক রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তবে এসব বিষয় কেউ প্রকাশ করতে চাইছেন না। তারা অবশ্য মনে করেন সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের কোনো প্রভাব বাংলাদেশের বাণিজ্যে পড়বে না।
জানতে চাইলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের কোনো প্রভাব দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর পড়বে না। কারণ ব্যবসা ব্যবসার জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।’