২৭ মে ২০২৩
নিজস্ব প্রতিনিধি
‘১০ বছর হয়ে গেছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবাকে খুঁজছি। কিন্তু আমি আমার বাবাকে পাই না। আমারও ইচ্ছে করে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে। আমার বন্ধুরা বাবার সাথে স্কুলে যায়। আমারও ইচ্ছে করে বাবার সাথে স্কুলে যেতে। আমি কেন পারি না! আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। আর ভালো লাগে না বাবাকে ছাড়া।’
রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে গুম করা রাজনৈতিক কর্মীর কন্যা সাফা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এ কথা গুলো বলছিলেন শনিবার মানববন্ধনে।
র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা গুলে তুলে নিয়ে গুম করা ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক সপ্তাহ উপলক্ষ্যে শনিবার (২৭শে) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এই মানববন্ধনে শেখ হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে গুম করা রাজনৈতিক কর্মী ও ভিন্নমতের ব্যক্তিদের আপনজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের সংগঠন “মায়ের ডাক” এই মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল।
প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর রাজধানী থেকে বিরোধী জোটের একাধিক নেতা ও কর্মীকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় এই শিশুটির বাবা সোহেলকে (চাচা সোহেল নাম পরিচিত) শাহবাগ থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। এরপর থেকে আজও সন্ধান মেলেনি তার।
চাচা সোহেলের সঙ্গে ছিলেন বংশাল থানা ছাত্রদল নেতা চঞ্চল, বংশাল ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো. জহির এবং ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেন। তাদের কারও সন্ধান আর মেলেনি।
সাফার মতো অসংখ্য স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, সরকার বিগত এক দশক ধরে বিরোধী মতের মানুষের ওপর গুম, খুন, হত্যা ও নৈরাজ্য চালাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে গুম করেছে। আজও তাদের খোঁজ নেই। আয়না ঘরের নামে নির্যাতন সেল তৈরি করেছে। এসমস্ত অবিচার বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দিতে হবে।
মানববন্ধনে ঘোষণা পত্র পাঠ করেন মায়ের ডাক এর অন্যতম উদ্যোক্তা আফরোজা ইসলাম আঁখি। তিনি বলেন, স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে গুমের ঘটনায় অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সরকারের সময় ফুরিয়ে আসছে। প্রত্যেকটা ঘটনার বিচার হবে এ বাংলাদেশে। কেউ ছাড় পাবে না।
তিনি বলেন, কাউকে গুম করে ফেলা শুধুমাত্র ব্যক্তি বিশেষের মানবিক অধিকার লঙ্ঘন নয়, একই সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। গুম করার অপরাধে যখন খোদ রাষ্ট্র অভিযুক্ত হয়, তখন মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের কর্মী এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর জন্য তা এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরী করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত জাতিসংঘের প্রচলিত ঘোষণা, সনদ বা আইন গুমের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত না হওয়ায় নতুন একটা আন্তর্জাতিক বিধানের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। সেই কারণেই ২০০৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর জাতিসংঘে গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন গৃহীত হয়।
গুম বা এনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে গৃহীত হয়। গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদের অনুচ্ছেদ-২ এ এটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
“গুম করা” বলতে বুঝায় “রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, সাহায্য অথবা মৌনসম্মতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক সংঘটিত গ্রেফতার, বিনা বিচারে আটক, অপহরণ অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে স্বাধীনতা হরণকে, যা কিনা সংঘটিত হয় স্বাধীনতা হরণের ঘটনা অস্বীকার অথবা গুম করা ব্যক্তির নিয়তি এবং অবস্থানের তথ্য গোপন করে তাকে আইনি রক্ষাকবজের বাইরে রাখার ঘটনাগুলোর মাধ্যমে সংঘটিত করা।
“গুম” ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং সংগঠনের স্বাধীনতাকে খর্ব করা। গুম জনিত অপরাধকে ধারাবাহিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ আটক বা অপহরণের পর এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে।
এছাড়া বাংলাদেশ ২০১০ সালে ২৩শে মার্চ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম সংবিধিতে অণু স্বাক্ষর করেছে। রোম সংবিধিতেও গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, মায়ের ডাকের সানজিদা ইসলাম প্রমুখ।
গুমে জড়িত কারা?
কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘গুম’ সংস্কৃতি জেঁকে বসে। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে শেখ হাসিনা। তাঁর শাসনামলে গুমের সংস্কৃতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই বিএনপিসহ ১৯-দলীয় জোটের শরীক দল গুলোর নেতা-কর্মী।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা পরবর্তীতে যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করা জানা গেছে যে এসব গুমের সাথে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত। কোনো কোনো গুমের ঘটনায় বাহিনীর নির্ধারিত পোশাক পরে আসলেও, কিছু ঘটনায় সাধারণ পোশাকেই গুম করা হয়েছে। প্রকাশ্যে এসব গুমের জড়িতদের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও পরিচয়পত্র বহন করতে দেখা গেছে। তবে, গুমের পর বরাবরের মতোই বেমালামু অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
শেখ হাসিনার পুরো শাসন আমল জুড়েই বাংলাদেশে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু প্রায়শ সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
আওয়ামী লীগপন্থী মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। গুম হওয়াদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেছে ৭৮ জনের লাশ।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের গড়া সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের এ পর্যন্ত ৫৩৮ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তবে অনেক দিন পর ৩০০ জন ফিরে এসেছেন। ৬৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ১৭০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।