শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে স্থায়ী জামিন পেয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৪ জন। মামলা
নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে এই জামিন দিয়েছেন আদালত। গতকাল সকাল ১০টায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে আপিল করেন ড. ইউনূস। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) এম এ আউয়াল তার জামিন মঞ্জুর ও আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আগামী ৩রা মার্চ আপিল শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেন আদালত। আদালত থেকে বেড়িয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সাজা কি দেবে না দেবে, এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমাদের। আমরা নতুন পৃথিবী গড়বো।
এর আগে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আসেন ড. ইউনূসসহ ৪ জন। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের দেয়া সাজার রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল এবং জামিন চেয়ে আবেদন করেন ড. ইউনূস। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, সাজা-অসাজা ছোট্ট জিনিস।
আমি বৃহত্তর ছকের মধ্যে আছি। আমার প্রত্যাশা হচ্ছে- আমরা নতুন পৃথিবী গড়বো, আমরা তিন শূন্যের পৃথিবী গড়বো। থ্রি জিরো ওয়ার্ল্ড। এগুলো ছোটোখাটো বিষয়, সাজা কি দেবে না দেবে, এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমাদের। তিনি বলেন, আরেকটা জিনিস পরিষ্কার করি, আপনাদের জানানো দরকার। সরকার বারবার বলছে, এই মামলাটা সরকার করে নাই। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর তো সরকারি, সরকারের অধীন। শ্রমিক তো কোনো মামলা করেনি।
ড. ইউনূস বলেন, দারিদ্র্যসহ পৃথিবীর যত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তার গোড়ায় হলো আমাদের মূল তাত্ত্বিক ব্যবস্থা। সেটার পেছনে আমরা লাগলাম। আমরা একটা ইমাজিনেশনকে (কল্পনা) গুরুত্ব দিলাম। ইমাজিনেশনই হচ্ছে মানুষের মূল শক্তি। ইমাজিনেশন না থাকলে কিছু হবে না। ব্যবসাকে নতুন কাঠামোতে আনতে হবে। তখনই আমরা বললাম সামাজিক ব্যবসা। এই সামাজিক ব্যবসার খাতিরে, শিক্ষার খাতিরে শিক্ষা ব্যবস্থাটাও একটা চিন্তার কারাগার। আবদ্ধ করে রেখেছে। এই কারাগার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা বললাম, শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে হবে। সেখানে মানুষ চাকরির জন্য লেখাপড়া করবে না। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য লেখাপড়া করবে।
ড. ইউনূস বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকটা ছিল আমাদের স্বপ্ন। আমরা পৃথিবীকে বদলাতে চাই, দারিদ্র্যকে মুছে ফেলতে চাই। এটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আমরা পেছনে লেগেছিলাম। জানি না ভবিষ্যতে আমাদের কী হবে না হবে। আমাদের কোনো কিছু জানা ছিল না। আমরা গিয়েছি। প্রতিটি খুঁটিনাটি দেখে দেখে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ফলে গ্রামীণ ব্যাংক আস্তে আস্তে প্রসারিত হলো। নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আমাকে বের করে দেয়া হলো। বীজতলা রয়ে গেল একদিকে, আমাদের লোকজন যারা খেটেছে তারা রয়ে গেল আরেক দিকে। আমরা যাবো কোথায়? আবার আস্তে আস্তে বড় করলাম। কি করেছি আমরা? আমরা বলেছি চাকরির পেছনে মানুষ ঘুরবে না। চাকরি মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ হলো উদ্যোক্তা। তার জন্মই হয় উদ্যোক্তা হিসেবে। এই (চাকরি) কাঠামো ভুল। এর পেছনে আমরা লাগলাম। সকল মানুষ উদ্যোক্তা। ব্যাংকিং সেক্টরের ভুল কাঠামোর কারণে মানুষ আজ চাকরির পেছনে ছুটছে। চাকরিটা হলো দাসত্বের একটা জিনিস। আপনি একজনের জন্য জান দিয়ে খাটবেন অথচ মাসের শেষে, দিনের শেষে আপনাকে কিছু ভাগ দেবে রোজগারের অল্প সামান্য! এই দাসত্ব থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাই। আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের নমুনা দিলাম। গ্রামের অশিক্ষিত মহিলা অল্প-স্বল্প টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে নেমে গেছে। কে বলে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাই? নিয়ে আসলাম সামনে, যেন উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা উন্মুক্ত করতে পারি। মূল অর্থনৈতিক তত্ত্বকে আমরা চ্যালেঞ্জ করলাম।
আদালতে ড. ইউনূসের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুল্লাহ আল-মামুন, খাজা তানভীর আহমেদ ও এসএম মিজানুর রহমান। অপরদিকে কলকারখানার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। পরে ড. ইউনূসের আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, আদালত আমাদের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন এবং নিম্নআদালতের রায় সাসপেন্ড করেছেন। একইসঙ্গে আগামী ৩রা মার্চ নিম্নআদালতের সেসব নথি আনার জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন। আর আপিল শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে স্থায়ী জামিন দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সর্বমহলে এমনকি বিদেশিদের কাছেও বলা হচ্ছে এ মামলা সরকার করেনি। কিন্তু ঘটনাটা সঠিক নয়। সরকার তার প্রতিষ্ঠান কলকারখানা অধিদপ্তরের মাধ্যমে এ মামলা করেছে। সরকারি নির্দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান এ মামলা করেছে। মামলায় যে রায় হয়েছে সেটা। আইন অনুযায়ী হয়নি। আইনে বলা হয়েছে, যদি বকেয়া থাকে তাহলে সেটা পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট সময় দেয়া হবে। এটা না করলে ১ লাখ টাকা জরিমানা, প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা করে। পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি আইন অনুযায়ী এটা আদায় করা হবে। কিন্তু সেসব ভায়োলেট করে বিশ্বের কাছে নন্দিত নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ও তার বন্ধুদের সামাজিক ব্যবসা ধ্বংস করার জন্য করেছে।
১লা জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত ড. ইউনূসসহ ৪ জনকে ৬ মাস করে কারাদ- দেন। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সাজাপ্রাপ্ত অপর ৩ জন হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।