মানবাধিকার নিয়ে হুঁশিয়ারি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না

মো. তৌহিদ হোসেন : যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক অংশীজনের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে দাবি করছে। একই সঙ্গে দেশটির রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাগারে নিক্ষেপ করছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর বিএনপি ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের ডাক দেয়। কর্মসূচি চলাকালে এবং এর পরে পুলিশ, বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী-সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে সব পক্ষের দায় থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী চলমান সহিংসতায় তাদের ভূমিকার জন্য দায়মুক্তি ভোগ করছে। কিন্তু বিরোধী দলের সদস্যরা ব্যাপকভাবে, প্রায়ই নির্বিচার গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছে। সংগঠনটি বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ যে বিরোধীদের ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির’ জন্য দায়ী করে বিএনপির কার্যালয় অপরাধস্থল (ক্রাইম সিন) হিসেবে বর্ণনা করে সিলগালা করেছে, তাও উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, যখন সরকার স্বাধীন মতপ্রকাশ বন্ধ করে দেয়; নির্বিচার গ্রেপ্তার, গুম, হয়রানি, ভয় দেখানোর মাধ্যমে বিরোধী, সমালোচক ও অধিকারকর্মীদের পদ্ধতিগতভাবে অকার্যকর করে দেয়, তখন একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব।

প্রথম কথা হলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি ও তার মিত্রদের সঙ্গে সরকার কেমন আচরণ করছে, সে সম্পর্কে যা বলেছে, তা এ দেশের মানুষের চোখের সামনেই ঘটেছে এবং ঘটছে। সুতরাং সংগঠনটির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই; যদিও অ্যাটর্নি জেনারেলকে দেখলাম তিনি বলেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য সঠিক না বা এ রকম কিছু। অবশ্য এটা আমাদের শাসকদের সংস্কৃতিরই অংশ, কারও কোনো বক্তব্য তাদের পক্ষে না গেলে সেটাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে আখ্যা এবং উড়িয়ে দেওয়া। হয়তো সরকারপক্ষের আরও কেউ এমনতর বক্তব্য নিয়ে আসবেন।

এখন এ পরিপ্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় সম্পর্কে বলেছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে তাদের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা যাতে বজায় রাখে, সে ব্যাপারে বিদেশি সরকারগুলোকে জোর দেওয়া উচিত। সংগঠনটি এমনও বলেছে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অংশীজনের এটা স্পষ্ট করা উচিত– সরকারের কর্তৃত্ববাদী দমন-পীড়ন ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বিপন্ন করবে। এ কথাগুলো নিঃসন্দেহে তাৎপর্য বহন করে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের আসন্ন নির্বাচন বিষয়ে মূল আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। এদের মধ্যে অন্য বিষয়ে পরস্পর বৈরী হলেও, আমাদের নির্বাচন নিয়ে চীন-ভারত একই মত পোষণ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ দুই রাষ্ট্রের অবস্থানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্কিন কর্মকর্তারা বরাবরই বলে আসছেন, এ দেশে তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান। কেন তারা এখানে এর কম বলছেন; অন্য দেশের ক্ষেত্রে বলছেন না– সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তারা এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা এখানে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়– এটিই মূল কথা। আমরা এটাও জানি, তাদের এ প্রত্যাশা যে নিছক কাগুজে নয়, তার প্রমাণ দিতে ইতোমধ্যে তারা এ দেশের ওপর ভিসা নীতি কার্যকর করেছে। সামনে হয়তো তা আরও জোরদার হবে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, পশ্চিমারা এ ধরনের সংগঠনের প্রতিবেদনকে মূল্য দেয়। এদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা এ ধরনের রাষ্ট্র বিশেষত বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সাহায্য-সহযোগিতাদানের ক্ষেত্রে তাদের পলিসি নির্ধারণ করে। ওই দেশগুলো কিন্তু বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা সরকারি কোনো সংস্থার দ্বারস্থ হয় না। একটি জরিপের ফল বেরিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থান হলো ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন; তার পরেই আছে আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অতএব আমাদের সরকার বা তাদের কোনো সমর্থক হয়তো হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আলোচ্য বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, কিন্তু এতে প্রলয় বন্ধ হবে না।

আরেকটি কথাও বলা দরকার। এ ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ একেবারে সাধারণ মানুষের মতামতকে কতটুকু প্রভাবিত করে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য না থাকলেও, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা এলিট হিসেবে পরিচিত তাদের ওপর কিন্তু এর একটা প্রভাব পড়ে। বিশেষত তারা নিজেরা যা চোখে দেখছে, সেটার একটা কনফারমেশন পায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অন্য কোনো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বক্তব্য থেকে। নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক যে কোনো সংস্থার পর্যবেক্ষণকে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সদস্যরা যার যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে। তবে যারা মনে করে, এখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ; যাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়; তারা কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থার একই বক্তব্য থেকে জোর পায়। এ অর্থে জনমতের ওপর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্যের কিছু না কিছু প্রভাব তো থাকেই।

এ আশঙ্কা কিন্তু অনেকের মধ্যেই কাজ করছে, যাদের মধ্যে অনেক অর্থনীতিবিদও আছেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে বাংলাদেশের ক্ষতি করতে পারে। এর মধ্যে ন্যায়-অন্যায় প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে এটি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমাদের অর্থনীতি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমার শেষ কথা হলো, শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচই আমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছে না; আরও অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলছে। আমি বলতে চাই, হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে তাকে অন্য সব সংস্থার সঙ্গে মিলিয়ে বিবেচনা করতে হবে। তবেই এসবের পরিণাম সম্পর্কে একটি ধারণা আমরা পাব। এ মুহূর্তে এসব সংস্থার বক্তব্য আমাদের দেশটা যারা চালাচ্ছেন; যাদের হাতে জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে, তাদের পক্ষে যাচ্ছে না। এটিই সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব 

সমকাল