মহামান্যের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ‘ইচ্ছাপূরণ’

মহামান্যের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ‘ইচ্ছাপূরণ’

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ইচ্ছাপূরণে লাভজনক দেখিয়ে কিশোরগঞ্জের হাওরে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকায় উড়াল সড়ক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এ জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় দেখানো হয়, ২০২৭ সালে উড়াল সড়কে দৈনিক গড়ে ১৬ হাজার ৬৬৬ এবং ২০৩০ সালে ২৫ হাজার ৭০৮টি যানবাহন চলবে।

এর আগে হাওরে সড়ক নির্মাণের সমীক্ষায়ও বলা হয়েছিল, ২৬ হাজার যানবাহন চলবে। তবে উদ্বোধনের চার বছর পর অল্প কিছু মোটরসাইকেল, অটোরিকশা চলছে। লাভ দূরে থাক, হাওরের বুক চিরে নির্মিত সড়কটি বন্যা এবং পরিবেশগত সংকট সৃষ্টির কারণ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০ কোটি টাকা খরচায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূর্ত বিভাগের করা সমীক্ষায়ও বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সেতু কর্তৃপক্ষের জন্য লাভজনক হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে প্রতিদিন ২৫ হাজার ৭০৮ যানবাহন চলাচল করবে। বাস চলবে ১ হাজার ৩৮২টি। যদিও পরিবহন মালিকরা সমকালকে জানিয়েছেন, ব্যস্ততম সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম পথেও এত বাস চলে না।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উড়াল সড়কে ২০২৭ সালে প্রতিদিন ১৩ হাজার ২১৭ এবং ২০২৩ সালে ১৫ হাজার ১৪২টি মোটরসাইকেল চলবে। সেতু বিভাগের তথ্যানুযায়ী, পদ্মা সেতুতে দিনে তিন হাজারের মতো মোটরসাইকেল চলে না।

হাওরের কম জনঘনত্ব এলাকায় কোথা থেকে এত গাড়ি আসবে– প্রশ্নে সমীক্ষায় যুক্ত থাকা অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বলেন, হাওর ঘিরে সরকারের আরও কিছু প্রকল্প আছে। সুনামগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখী সড়ক নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে সমীক্ষা অনুযায়ী যানবাহন চলবে। এর মধ্যে রিকশা, ব্যাটারি রিকশাকেও ধরা হয়েছে।

উড়াল সড়কের নির্মাণ খরচ উঠবে টোলে। তবে সমীক্ষায় সম্ভাব্য টোল ধরা হয়েছে যমুনা সেতুর চেয়েও বেশি। গ্রামীণ এলাকায় এত টোল কে দেবে!  এ প্রশ্নের জবাব নেই। বছরওয়ারি আয় কেমন হতে পারে, সেই পূর্বাভাসও নেই। নির্মাণের পর কর্তৃপক্ষ টোল হার ঠিক করবে। সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। হাওরের উড়াল সড়ক প্রত্যাশিত টোল আয় না হলে লোকসানে পড়বে।

২০২২ সালের জুনে সমীক্ষা প্রতিবেদন দেয় বুয়েট। সেতু কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, উড়াল সড়ক নির্মাণে চাপ ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতির। এ কারণেই প্রকল্পটিকে লাভজনক দেখানো হয় সমীক্ষায়। সমীক্ষা চলাকালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া চারটি চিঠি পেয়েছে সমকাল। এর সবগুলোতে বলা হয়েছে, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’

২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়েন আবদুল হামিদ। এর তিন মাস আগে ১৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় কিশোরগঞ্জের মিঠামইন সদর থেকে মিঠামইন সেনানিবাসকে সংযুক্ত করে করিমগঞ্জ পর্যন্ত হাওরের ওপর দিয়ে ১৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক নির্মাণ এবং নাকভাঙ্গা মোড় থেকে মরিচখালী বাজার পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প অনুমোদন হয়।

অর্থনৈতিক সংকটে সেই সময় সরকার কৃচ্ছ্রনীতি অনুসরণ করলেও সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, গত ১৩ মার্চ আহ্বান করা আন্তর্জাতিক দরপত্রে ১২ প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এখন মূল্যায়নের কাজ চলছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী, এই কাজের ব্যয় ৪ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এই অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) উড়াল সড়কের জন্য ১ হাজার ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৮ সালের জুনে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে।

সাবেক রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় এবং সমীক্ষার বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রকল্প পরিচালক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ কথা বলার আমি কেউ নই। এটি নীতিনির্ধারণী বিষয়।’

সড়ক ও সেতু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সমকালকে বলেছেন, বাস্তবায়নের আগে যাচাইবাছাই করা হবে। দেখা হবে, প্রয়োজন আছে কিনা।

ফাওজুল কবির বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি বলেছিলেন, ‘বাস্তবায়নযোগ্য দেখাতে দিনে ২৫ থেকে ৩০ হাজার গাড়ি চলাচলের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।’ হাওরে এত গাড়ি কোথা থেকে আসবে– এই প্রশ্নও তুলেছিলেন।

মিঠামইন, ইটনা, অস্টগ্রাম নিয়ে গঠিত সংসদীয় এলাকার সাতবারের এমপি ছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এমপি হন তাঁর ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিলুপ্ত করা দ্বাদশ সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কমিটির চার সভার আলোচ্যসূচিতে ছিল হাওরের উড়াল সড়ক। রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।

সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, প্রকল্পটি নিতে চাপ ছিল। গত বুধবার প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পকে লাভজনক দেখিয়ে অনুমোদনের জন্য অতিরঞ্জিত তথ্য দেওয়া হয় সমীক্ষায়। ফরমায়েশি সমীক্ষা করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) সঙ্গে জমা দিয়ে অনুমোদন করা হয়।

উড়াল সড়ক প্রকল্প অনুমোদনের সময় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এম এ মান্নান। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হাওরে উড়াল সড়ক প্রকল্প কীভাবে অনুমোদন পেয়েছিল, তা জানতে যোগাযোগ করলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সেই সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে দায়িত্ব পালন করা এক কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রপতির ইচ্ছায় দ্রুত অনুমোদন দিতে হয়েছিল। এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা থাকে। রাষ্ট্রপতির চাপ থাকায় ঋণ না খুঁজে তাঁর মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগে আর্থিক সংকটের মধ্যে দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছিল।

সূত্র জানায়, সাবেক রাষ্ট্রপতির চাওয়ায় ২০১৬ সালে শুরু হয় মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রামকে যুক্ত করার সড়ক। ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি নির্মাণে খরচ হয় ৮৭৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালে সড়কটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় এবং পরিবেশবাদীদের ভাষ্য, এই সড়কের কারণে ঢলের পানি হাওর থেকে নামতে দেরি হয়। বৈশাখে পানি ধানক্ষেতে জমে ফসলের ক্ষতি করে। আওয়ামী লীগের পরিকল্পনামন্ত্রী গত জুনে বলেছিলেন, ‘এই সড়কের কারণে নিজের পায়ে কুড়াল মারা হয়েছে।’

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এখনও সড়কটির প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন করেনি। এই সড়কটি হলেও জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হয়নি যুক্তিতে উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, উড়াল সড়ক এবং প্রশস্ত করা মরিচখালী-নাকভাঙ্গা সড়ক মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রামকে যুক্ত করবে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে। মিঠামইনের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাসও যুক্ত হবে।

সড়কটি নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম অবসরের পর বিদেশে রয়েছেন। টেলিফোনে সমকালকে বলেন, ‘সমীক্ষা তো আমি করিনি। গাড়ি কেন কম চলছে, তা আমি বলতে পারব না। যারা সমীক্ষা করছেন, তারা বলতে পারবেন।’

হাওরের সড়কে মতো উড়াল সড়কেও সমীক্ষা অনুযায়ী যানবাহন চলবে না, তথা লোকসানের শঙ্কা করছেন সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, হাওরে জাতীয় মহাসড়ক নেই। ফলে দিনে ২৬ হাজার যানবাহন চলাচলের পূর্বাভাস গ্রহণযোগ্য নয়। সড়কের চেয়ে উড়াল সড়কে পরিবেশগত ক্ষতি কম হবে। তবে তিন উপজেলার ফসল পরিবহনের মাধ্যমে উড়াল সড়ক প্রকল্প লাভজনক হবে না। হাওরে গ্রামগুলো পানিতে বিচ্ছিন্ন। উড়াল সড়ক পর্যন্ত আসার মতো রাস্তা নেই। ফলে উড়াল সড়ক হলেও সবার ব্যবহারের উপযোগী হবে না। আবার গ্রামগুলোকে সড়কের মাধ্যমে যুক্ত করলে বিপুল ব্যয় এবং হাওর ধ্বংস হবে।

২৫ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচলের পূর্বাভাস দেওয়া হলেও নকশা অনুযায়ী উড়াল সড়ক হবে দুই লেনের। উড়াল সড়কের দু্ই প্রান্তে টোলপ্লাজা, পর্যটকদের জন্য তিনটি মঞ্চ থাকবে। ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের জন্য ১৫১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এখনও জমি বুঝে পায়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

samakal