মমতা কেন কৌশল পরিবর্তন করছেন

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
শুভজিৎ বাগচী

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি এমন দুটি কথা বলেছেন, যা তিনি ১৩ বছরের শাসনকালে বলেননি। গত ২৪ জুন তিনি বলেছেন, বেআইনি দখলদারে রাজ্য ও রাজধানী কলকাতা ভরে গিয়েছে। দলের নেতারা উৎকোচ নিয়ে বাইরে থেকে দখলদারদের বসাচ্ছেন। কিছু নেতার নামও করেন। পাশাপাশি দ্বিতীয় যে কথা বলেছেন, তা আরও বিতর্কিত।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পাঁচ রাজ্য থেকে আসা বহিরাগতরা বাংলার সংস্কৃতি ও সত্তা পাল্টে দিচ্ছে। এই অবাঙালি ও বহিরাগতদের সাবধান করে দিয়ে মমতা বলেন, পাঁচ রাজ্যের বোঝা তিনি টানতে পারবেন না। বাংলাভাষী রাজ্যের ভাষা-সংস্কৃতিগত চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার বিপদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি জমিতে বসা কয়েক লাখ হকারসহ অবৈধ দখলদারদের সরাতে পথে নেমেছে প্রশাসন-পুলিশ। প্রশ্ন হচ্ছে, আপাতত নির্বাচন না থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী কেন এ মন্তব্য করলেন, বিশেষত যখন মমতাকে গরিবদরদি নেত্রী বলে মনে করা হয়?

প্রথম কারণ

পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সাম্প্রতিক নির্বাচনে পেয়েছে ২৯টি। এ ফল ২০১৯ সালের তুলনায় ভালো। কিন্তু শহর বা মফস্‌সল এলাকায় ফল হতাশাজনক। পশ্চিমবঙ্গের ১২৫টি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটি এলাকার ৬০ শতাংশ ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। স্পষ্টতই শহরাঞ্চল তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু গ্রাম ঢেলে ভোট দিয়েছে একাধিক গ্রামমুখী সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পের কারণে।

মধ্যম ও উচ্চমধ্যম আয়ের মানুষ এ ধরনের সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের আওতার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়ে না। ফলে পশ্চিমবঙ্গে শহরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান বক্তব্য হলো, তাদের টাকায় গ্রামকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের দাবিতে—যেমন শিক্ষিত বেকারদের কাজের সুযোগ, দুর্নীতি দমন বা শিল্পায়ন—তৃণমূলের আগ্রহ নেই।

একনজরে এটা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য খারাপ নয়। কারণ, ২০১১ সালের আদমশুমারি মোতাবেক, বাংলার ৬৮ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। তবু এক-তৃতীয়াংশ ভোটারকে অবহেলা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বিশেষত যখন ২০১৯ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে তৃণমূলের ভোট কমছে। আগামী দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ১২৫টি পৌরসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের তাৎপর্য বিবেচনা করে মমতা দুর্নীতি ও ফুটপাত দখলের ইস্যু সামনে এনে শহরকে খুশি করতে চেয়েছেন এবং বলেছেন, টাকা নিয়ে বাইরের লোক বসানোর প্রবণতা নেতাদের বন্ধ করতে হবে।

দ্বিতীয় কারণ

দ্বিতীয় কারণ বা অভিযোগ আরও উদ্বেগের। বহিরাগত ও অবাঙালিদের বিরুদ্ধে মমতার অভিযোগ, তারা বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি-সত্তা পরিবর্তনের ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত। হিন্দি ও ইংরেজিকে সম্মান করেন বলে মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলার ‘বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে সহ্য করব না।’ অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী কার্যত সাবধান করে দিয়েছেন অবাঙালিদের।

এর কারণ হিন্দুত্ব ও বিজেপিকে রোখার তৃণমূলের মরিয়া চেষ্টা। ২০১৯ সাল থেকে দুটি লোকসভা ও একটি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩৮ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে মানুষকে এটা বোঝাতে পেরেছে যে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট নয়, বিজেপি। একদিকে কংগ্রেস-বামফ্রন্টের ভোট যখন উত্তরোত্তর কমছে, তখন বিজেপি নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে তৃণমূলের ঘাড়ে।

হিন্দুত্ববাদের হাওয়ায় ভর করে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনীতির যে হাওয়া তৈরি বিজেপি তৈরি করেছে, সেই হাওয়া ধুয়েমুছে সাফ হচ্ছে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট। এ অবস্থা বেশি দিন চললে রাজ্যে বিজেপির জয় অবশ্যম্ভাবী, যেমনটা সম্প্রতি হয়েছে ওডিশায়।

দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মমতা বুঝেছেন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া তিনি রুখতে পারবেন না। যেটা তিনি রুখতে পারবেন, সেটা হলো হিন্দুত্ববাদী আদর্শের হাওয়া।

নতুন কৌশল

হিন্দুত্ববাদকে রুখতে গেলে মমতার প্রয়োজন হিন্দুত্ববাদী আদর্শের পাল্টা ন্যারেটিভ (বয়ান), যেটা তৃণমূলের নেই। পশ্চিমবঙ্গে একটাই ন্যারেটিভ সামনে আসতে পারে—বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ভাষার প্রসার সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের এখনো একটা গভীর আবেদন আছে। এ আবেদন ঐতিহাসিক।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি স্বাধীনতার সময় নিজেদের পৃথক অবিভক্ত রাষ্ট্র চেয়েছিল। তারা মনে করেছিল, বাঙালির আলাদা রাষ্ট্রের অধিকার রয়েছে। এ দাবি তুলেছিলেন শরৎচন্দ্র বসু। তিনি বাঙালির একজন নায়ক। আর মহানায়ক শরৎচন্দ্র যাঁর অনুগামী ছিলেন, সেই সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর ভাই। দুই ভাই কংগ্রেস দলে নেহরু-গান্ধীর প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। কংগ্রেসের বিরোধিতার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মনে রেখেছে রাসবিহারী বসুকেও।

স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় রাজ্যের স্বার্থে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর প্রবল বিরোধিতা করেছেন, যে কারণে পশ্চিমবঙ্গে তিনিও নায়ক। এ কাজই পরবর্তী সময়ে করেছেন জ্যোতি বসু; তবে মূলত ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর বিরোধিতা করে। তাঁকেও মানুষ মনে রেখেছে, কিন্তু ভুলে গেছে রাজ্যের সেসব নেতা-নেত্রীকে, যাঁরা কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বঙ্গবন্ধুকেও মনে রেখেছে পাকিস্তানের যে পাঞ্জাব-নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্র, সেই কেন্দ্রের বিরোধিতার কারণে।

আজকের হিরো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেছনে মানুষ থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস। মমতা জানেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করতে গেলে কেন্দ্রের বিরোধিতা জরুরি। বস্তুত, এ একই কথা ভারতের অন্য অনেক রাজ্য, যেমন পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক থেকে কাশ্মীর সম্পর্কে প্রযোজ্য। এটাকেই ভারতে বলা হয় সাবন্যাশনালিজম বা উপজাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ সবার ওপরে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি চাপাতে গেলে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে পাল্টা লড়াই করা।

এ ক্ষেত্রেও সেই উপজাতীয়তাবাদের সাহায্য নিলেন মমতা, কারণ পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষত কলকাতার অর্থনীতি এখন প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে মাড়োয়ারি সমাজ। অন্যদিকে কায়িক শ্রম দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছে বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকে আসা মানুষ। কার্যত কলকাতা বাঙালির নেই। মমতার পক্ষে হোক বা বিপক্ষে, এটা নিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে প্রায় সব বাঙালিই দুঃখ করে।

এর সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার যুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দিভাষী মানুষ অর্থনীতি ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলেও খুব বড়ভাবে রাজনীতিতে অতীতে কখনো আসেনি। কিন্তু তিন-চার বা তার বেশি প্রজন্ম ধরে ব্যবসা করে যে অর্থ মাড়োয়ারি সমাজের নতুন প্রজন্মের হাতে জমেছে, তা ব্যবহার করে এবং বিজেপির সার্বিক উত্থানকে কাজে লাগিয়ে তারা রাজনীতিতে আসছে।

এটা তারা করতে পারছে; কারণ, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দিভাষী ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে। একটা সময়ের পর পশ্চিমবঙ্গের ভাষাগত জনবিন্যাস পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে এবং সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ‘এমন একটা সময় আসবে, যখন বাংলায় কথা বলার লোক থাকবে না।’

তবে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদভিত্তিক এই রাজনীতির উল্টো দিকও আছে। হাজার হাজার অবাঙালি দখলকার উচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রশাসনকে সমপরিমাণ বা বেশি বাঙালি হকারকেও উচ্ছেদ করতে হচ্ছে। এ কারণেই সংবাদ সম্মেলনে অবাঙালিদের সাবধান করে দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী দখলদারদের উঠে যাওয়ার জন্য এক মাস সময় দিয়েছেন। এই সময়ে তাদের কাগজপত্র খতিয়ে দেখা হবে। অর্থাৎ দুই পা এগিয়ে, আবার এক পা পিছিয়ে নির্দেশে সমতা আনার চেষ্টা করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে দুই বছরের মধ্যে আবার একাধিক নির্বাচন রয়েছে।

এ পদক্ষেপ বাঙালি হিন্দু ভোটের বড় অংশকে তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরিয়ে আনবে, নাকি বিজেপির উত্থান অব্যাহত থাকবে, রাজ্যবাসীর নজর থাকবে সেদিকে।