ঢাকা
- মতিউর রহমানের অবস্থান কোথায়, জানা যাচ্ছে না। সরকারের অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা করেছেন তিনি।
- প্রকাশ্যে আসছেন না মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ। যাচ্ছেন না উপজেলা পরিষদেও।
- ছেলে তৌফিকুর রহমানের নামে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানা রয়েছে। শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগ আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানের অবস্থান এখন কোথায়, সে বিষয়ে তাঁর স্বজন ও সহকর্মীরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছেও তাঁর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে দুদক জানতে পেরেছে, মতিউর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউরের দেশত্যাগে গতকাল সোমবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের দেওয়া এ নিষেধাজ্ঞার আওতার মধ্যে আরও রয়েছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাঁদের ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান (অর্ণব)। লায়লা কানিজ নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। কোরবানির ঈদের পর থেকে তাঁকেও আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। উপজেলা পরিষদেও যাচ্ছেন না তিনি।
মো. মতিউর, তাঁর প্রথম স্ত্রী ও ছেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা। সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ।
এনবিআরের সদস্যপদের পর মো. মতিউরকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি গত রোববারই জানা গিয়েছিল। এ–সংক্রান্ত আদেশ গতকাল জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ আদেশের মাধ্যমে মো. মতিউরকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হলো।
এনবিআরের সাবেক এই সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ–বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ হুন্ডি ও বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এ বিষয়ে দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, মতিউর রহমান অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন—এমন অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়েছে। তাঁরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। এনবিআরের সাবেক এই প্রভাবশালী সদস্যের সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দুদকের ওপর কোনো দিক থেকে চাপ নেই বলেও জানান তিনি।
মো. মতিউরের দ্বিতীয় সংসারের ছেলে মুশফিকুর রহমান (ইফাত) ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকায় ‘উচ্চবংশীয়’ ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আলোচনায় আসেন। তাঁর বিলাসী জীবনযাপনের নানা তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে।
ঈদের ছুটির পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার সরকারি অফিস খোলা থাকলেও মো. মতিউর এনবিআরে তাঁর কার্যালয়ে যাননি।
একজন সরকারি চাকরিজীবীর কলেজপড়ুয়া ছেলে কীভাবে এত বিলাসী জীবন যাপন করতে পারেন, সে প্রশ্ন ওঠে। একপর্যায়ে মো. মতিউর ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। আলোচিত এই কর্মকর্তা ও তাঁর স্বজনদের নামে এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, যশোর ও নাটোরে মোট ৮৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ (২৫ দশমিক ৭০ বিঘা) জমি রয়েছে। ঢাকাতেই তাঁর নামে ফ্ল্যাট রয়েছে অন্তত চারটি। ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে লায়লা কানিজ তাঁর মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
শেয়ারবাজারে মো. মতিউর পরিচিত ছিলেন বাজে কোম্পানির ‘প্লেসমেন্ট-শিকারি’ হিসেবে। স্ত্রী, ছেলে–মেয়েসহ নিজের নামে খোলা পাঁচটি বিও হিসাব থেকে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছেন তিনি। এর বাইরে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে ১৫টির বেশি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে।
পুলিশ যা করে, আইন মেনেই করে। তবে পুলিশ চাইলে যে কাউকে যেকোনো সময় স্টপ (থামানো) করতে পারে না। এ জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের বিদেশযাত্রার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নির্দেশনা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
মো. মতিউরের প্রথম সংসারের মেয়ে কানাডাপ্রবাসী ফারজানা রহমানের নামে গ্লোবাল শুজ অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেডের ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০টি শেয়ার এবং ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমানের নামে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০টি শেয়ার আছে। গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকদের একজন তৌফিকুর। এখানে তাঁর নামে ১০ লাখ শেয়ার রয়েছে।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। এনবিআর প্রশাসন শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, জমি, বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ—কোনো ক্ষেত্রেই এনবিআরের অনুমতি নেননি মো. মতিউর রহমান। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে যে ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেটি করতে গিয়ে তিনি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা
ঈদের ছুটির পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার সরকারি অফিস খোলা থাকলেও মো. মতিউর এনবিআরে তাঁর কার্যালয়ে যাননি। এরপর গত রোববার তাঁকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি) সংযুক্ত করা হয়। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত তিনি আইআরডিতে যোগ দেননি। তাঁর ব্যবহৃত দুটি ফোন নম্বর বন্ধ রয়েছে।
মো. মতিউর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন কাগজপত্রে তাঁদের ঠিকানা হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঢাকার তিনটি ফ্ল্যাটের (ধানমন্ডি, বসুন্ধরা ও কাকরাইল) কথা উল্লেখ করেছেন। গত তিন দিনে এই তিন ঠিকানায় প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক একাধিকবার গেছেন। কোথাও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
কোনো কোনো গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করা হয়েছে আলোচিত কর্মকর্তা মো. মতিউর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়েছেন। তবে এর সত্যতা সম্পর্কে দুদক বা পুলিশের দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মো. মতিউরের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদী, প্রথম স্ত্রীর বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীতে। তিনটি জায়গাতেই তাঁর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি এখন কোথায়, এ বিষয়ে স্বজনেরা নিশ্চিতভাবে কিছু জানাতে পারেননি।
দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা সহজেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, গতকাল সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, পুলিশ যা করে, আইন মেনেই করে। তবে পুলিশ চাইলে যে কাউকে যেকোনো সময় স্টপ (থামানো) করতে পারে না। এ জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের বিদেশযাত্রার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নির্দেশনা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।