- অধ্যাপক আশরাফ জামান
- ১৭ নভেম্বর ২০২২, ২০:১৬
বাংলার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া গ্রামে এক বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শরাফত আলী খান। মওলানার ডাকনাম চেগা মিয়া। পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ওস্তাদের কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি। ছয় বছর বয়সে বাবা মারা যান এবং মাত্র ১২ বছর বয়সে মা মৃত্যুবরণ করেন। পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে দুই ভাই, এক বোন ও মা মারা যান।
পিতৃমাতৃহীন অনাথ বালক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন পাননি। ওস্তাদের কাছ থেকে মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করেন এবং নিজ প্রচেষ্টায় উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, অহমিয়া, আরবি ও ইংরেজি শিখেন। তার শিক্ষা ও জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতের মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
বাবা বেঁচে থাকতে ময়মনসিংহের কল্পা গ্রামে ভাসানীকে পাঠানো হয় পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদীর কাছে। পরবর্তী সময়ে বোগদাদী সাহেবের সংস্পর্শে জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। ১৯০৬ সালে বোগদাদী সাহেবের মুসাফিরখানায়, হককুল্লাহ ও হককুল এবাদ মিশনের কাজ জোরেশোরে চলতে থাকেন। ভাসানী ছিলেন সেখানে যোগ্য সাগরেদ। বোগদাদী সাহেব বড় হুজুর এবং ভাসানী ছোট হুজুর হিসেবে পরিচিত হন। তখন থেকে মওলানা ভাসানী মাথায় তালের টুপি ব্যবহার করা শুরু করেন।
হামিদ খান ১৯০৮ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে আসাম আঞ্জুমানে ওলামার সভাপতি ও ১৯১৬ সালে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে হামিদ খান বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে পা বাড়ান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আজাদ সুবহানী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সংস্পর্শে আসেন।
মওলানা জমিদার প্রথা বিরোধী সংগ্রামে সাধারণ মানুষের মাঝে নিজ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বৃহৎ ভারতবর্ষে তিনি দেখতে পান প্রজা সাধারণের ওপরে জমিদার শ্রেণীর অত্যাচার জুলুমে বিপর্যস্ত গরিব নিরীহ নারী-পুরুষ। কিছু সময় কাগমারীতে শিক্ষকতা করেন। এ সময় থেকেই জমিদারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের ফলে টাঙ্গাইলের জমিদাররা ভীতসন্ত্রস্ত হন। এ কারণে তাকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়। ২৪ বছরের তরুণ মওলানা আসামে উঠলেন।
আসামে বাস্তুহারা বাঙালি জনগোষ্ঠী মওলানা ভাসানীকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে। ব্রিটিশ সরকার ঘোষিত ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩১ সালের এই সময় তিনি ভাসানচরে বসবাস করেন। ভাসানচরের অসামান্য নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে তিনি সমধিক খ্যাত হন ভাসানী নামে। ভাসানচরের জনগণ তাকে ভাসানী উপাধি দান করে যে উপাধি সারা বিশ্বে মাত্র একটি শব্দেই পরিচিতি বহন করে।
১৯৩৭ সালে বন্যাপ্লাবিত টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী এলেন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। ঘাঁটি করলেন কাগমারীতে। শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম। মুসলমানদের পক্ষ থেকে দাবি তুললেন সন্তোষে জমিদারির অধিকার। কাগমারীতে হজরত শাহজামানের মাজারের পাশে মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু সন্তোষের জমিদারদের চক্রান্তে সরকারের নির্দেশে আবার তিনি দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আসাম চলে যেতে বাধ্য হন। ৩৫ বছর বয়সে বগুড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আলেমা খাতুনকে তার ধর্মগুরুর নির্দেশে বিয়ে করেন। বগুড়ার বীরনগরের প্রতাপশালী জমিদারের মেয়ে আলেমা খাতুন মওলানা ভাসানীর মৃত্যুশয্যা অবধি পাশেই ছিলেন। এ ছাড়া আরো দু’বার বিয়ে করেন ভাসানী। তারা তার জীবিত থাকাকালেই মারা যান।
আসামের ১৩ বছরের প্রবাস জীবনে আট বছর কারাজীবন কেটেছে মওলানা ভাসানীর। বাঙালি প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১১ বছর সদস্য ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রস্তাবের ওপর টাঙ্গাইল মহকুমায় তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার ফলে মুসলিম লীগের পক্ষে বিপুল ভোট পড়ে।
ভাসানী ১৯৪৮ সালে আসামের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন। এসে সন্তোষে আস্তানা গড়েন। তিনি ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী নেতা। মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মত পেশ করেন। ইতিহাসে সময়োপযোগী এবং অগ্রগামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো দূরদর্শিতায় তাকে জাতীয় নেতা হিসেবে মর্যাদাবান করে তোলে। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা এলে মওলানা ভুখামিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১১ অক্টোবর আরমানিটোলার জনসভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা করেন এবং মুসলিম লীগের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। ১৬ অক্টোবর পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৫০ সালে জেলে অনশন ধর্মঘট চলাকালে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি কেটে দেয়ার জন্য দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে মওলানার মতবিরোধ ঘটে। এ বছর তিনি কৃষক সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল এবং ভাসানীকে অন্তরীণ করেন। ১৯৬৪ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের আহ্বান জানান ভাসানী। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ভাসানী ছিলেন এর অন্যতম আহ্বায়ক।
১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের (কপ) প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্নাহকে ভাসানী সমর্থন দান করেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ সব বিরোধী দল একযোগে কায়েদে আজমের বোন ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন প্রদান করে। পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের একতা ও সংহতির প্রতি সব দল সমর্থন জ্ঞাপন করে।
১৯৬৮ সালের শেষ দিকে মওলানা ভাসানী আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করেন, যার পরিণামে ১৯৬৯ সালে হয় গণ-অভ্যুত্থান। আইয়ুব গদি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন মওলানা ভাসানীর আপসহীন আন্দোলনের চাপে।
১৯৭০ সালে ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৭০-এর নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের নিন্দা করেন তিনি। ৪ ডিসেম্বর ভাসানী পল্টনের জনসভায় প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন। ১৯৭১ সালের ৯, ১০, ১১ ও ১২ মার্চ যথাক্রমে মোমেনশাহী, খুলনা ও রাজশাহীর বিশাল জনসভাগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন’।
আসামে থাকাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানহীন আসামে ৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। বগুড়াতে হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজ, পাঁচবিবি উচ্চবিদ্যালয়, রংপুরে একটি উচ্চবিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে বিন্নাফৈর হাইস্কুল, মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ ও তার জীবনের শেষ সৃষ্টি সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে স্কুল, কলেজসহ ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত। ‘শিক্ষা প্রত্যেক নরনারীর জন্য ফরজ’- ইসলামের এই শাশ্বত বাণী, মহানবী সা:-এর আদর্শ সারা জীবন মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারত চলে যান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল পল্টনের জনসভায় চোরাচালানের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতি আপসহীন মনোভাব ব্যক্ত করেন। এ সময় সৈয়দ ইরফানুল বারীর সম্পাদনায় নিজস্ব মুখপাত্র সাপ্তাহিক হককথা প্রকাশ করেন।
১৯৭৩ সালে বাংলার মানুষের দরদি বন্ধু আপসহীন মওলানা সরকারের দায়িত্বহীনতা, শৃঙ্খলাহীনতা ও দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে বৃদ্ধ বয়সে অনশন করেন। আন্দোলন করতে গেলে সরকার তাকে গৃহবন্দী করে।
চীন, মিসর, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মওলানা ভাসানী সফর করেছেন। চীনের নেতা মাও সেতুং, চৌ এনলাই, মিসরের নেতা নাসেরসহ অনেক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তার বন্ধু।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি একতরফা প্রত্যাহার এবং ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে অশীতিপর নেতা ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে সংগ্রামী মহানায়ক, বাংলার মানুষের নয়নমণি, মজলুম জনতার কণ্ঠস্বর, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মৃত্যু করেন। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন। আমিন।