জামায়াতের সঙ্গে জোটের সুযোগ নেই, এনসিপির সঙ্গে আলোচনা উন্মুক্ত -সালাহউদ্দিন
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অনেকটা স্বস্তিতে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করতে নির্দেশনা দেওয়ার পর ভোট নিয়ে ধোঁয়াশা কেটেছে। মোটা দাগে তিনটি দাবি পূরণ হলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোট হওয়া নিয়ে আপত্তি না থাকার কথা জানিয়েছে দলগুলো। এর মধ্যে বিচার দৃশ্যমান হচ্ছে। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়াও চলছে। সবকিছু ইতিবাচক পথে চলায় মাঠের চিত্রও পালটাতে শুরু করেছে। নির্বাচনি ট্রেনে উঠছে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোও।
এদিকে নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতা না করার কথা জানিয়েছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। তবে তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখার ইঙ্গিত দিয়েছে দলটি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে নির্বাচনি জোটের কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। অতীতে কৌশলগত কারণে আমরা জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছি; কিন্তু এবার তাদের সঙ্গে জোট গঠনের প্রয়োজন অনুভব করছি না। বিএনপি এখন মূলত সেই দলগুলোর সঙ্গে জোট ও জাতীয় সরকার গঠনে মনোযোগী, যারা একযোগে আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। এখন এর বাইরে কিছু ভাবা হচ্ছে না।’
তবে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, ‘কী হয়, তা সময়ই বলে দেবে। সব গণতান্ত্রিক দলই নির্বাচনের আগে নানা কৌশল গ্রহণ করবে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী কৌশল অবলম্বন করে এবং কার সঙ্গে জোট করে, এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব যুগান্তরকে বলেন, ‘এনসিপি নির্বাচনের আগে জুলাই ঘোষণাপত্র ও মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে জুলাই সনদ দেখতে চায়। এছাড়া জুলাই গণহত্যার বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতিও আমরা দেখতে চাই। এর আগে আমরা নির্বাচনের বিষয়ে ভাবছি না। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ হয় এবং বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি সম্ভব হয়, তাহলে নির্বাচনের তারিখ, সময় নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি জোটের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আমাদের সরাসরি কথা হয়নি। আমরা এ মুহূর্তে নির্বাচনি জোট নিয়ে ভাবছি না।’
এদিকে জামায়াতে ইসলামীও একটি ‘নির্বাচনি সমঝোতা’ করার চেষ্টা করছে ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে। ব্যালটে ইসলামপন্থি দলগুলোকে একসঙ্গে চায়। যদিও আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি রয়েছে।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের যুগান্তরকে বলেন, ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আলাপ-আলোচনা চলছে কীভাবে কী করা যায়। ঐকমত্য কমিশনের ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হলেই তখন এর অগ্রগতি বোঝা যাবে। সময় গেলে তা আরও স্পষ্ট হবে।
এদিকে লন্ডন বৈঠকের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর একধরনের সংশয় ও সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। বুধবার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশনা দেওয়ায় দলগুলোর সংশয় কিছুটা কেটেছে, স্বস্তিও ফিরেছে, বিশেষ করে বিএনপিতে। কারণ, গত জুনে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে।
এদিকে সরকারের দেওয়া ভোটের এই সময়সীমার ওপর জামায়াতে ইসলামীও আস্থাশীল বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে এ ভোট যেন আওয়ামী লীগ আমলের মতো না হয়, সে নিশ্চয়তা চায় দলটি। অন্যদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ হয় এবং বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি সম্ভব হয়, তাহলে নির্বাচনের তারিখ, সময় নিয়ে কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছে তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে পাঁচটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চার নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে এ পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়। নির্বাচনের প্রধান আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)’-এ কমবেশি অর্ধশত সংশোধনী এনে একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পর নির্বাচন কমিশন কাজের গতি বাড়িয়েছে, যা তারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে রাখার জন্য, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার।’ একই সভায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সরকারের দেওয়া ভোটের সময়সীমার ওপর তার দল আস্থাশীল বলে জানান। তবে এই ভোট যেন আওয়ামী লীগ আমলের মতো না হয়, সে নিশ্চয়তা চেয়েছেন তিনি। গোলাম পরওয়ার এও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে চাইছি। কিন্তু বারবার একটি অপশক্তি সেই পথে বাধার সৃষ্টি করছে।’
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁর দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। কোন কোন জায়গায় আলোচনা আটকে যাচ্ছে, তাও জানতে চান প্রধান উপদেষ্টা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা কয়েকটি সংস্কারের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বাধীনভাবে নিরপেক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ভবিষ্যতে কোনো দল চাইলেই যাতে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলতে না পারে, সে ধরনের বিধান এবং নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। এসব সংস্কার নিশ্চিত করেই নির্বাচন করার পক্ষে মত দেন প্রধান উপদেষ্টা।
তবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি এবং নারী আসনে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের কয়েক দফা আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত ঐকমত্য হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি আছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিএনপি অনেক ছাড় দিয়েও রাজি হয়েছে। এখন শর্ত দিয়ে যদি সব চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দরকার কী। দেখা যাক কী হয়।’
বিএনপির ওই নীতিনির্ধারক আরও বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের দাবি মূলত একই। এর মধ্যে বিচার ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিএনপি সংস্কারের ব্যাপারে সবচেয়ে আন্তরিক। তবে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যেই আলোচনা শেষ হওয়া উচিত ছিল। আশা করি, এ আলোচনা আর বেশি দিন চলবে না। এখন একটা সারসংক্ষেপ ও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার। যার ভিত্তিতে দ্রুতই জুলাই সনদ করতে পারবে, যেখানে সব দলের স্বাক্ষর থাকবে। আর জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়েও বিএনপি ইতিবাচক। এ সংক্রান্ত নতুন খসড়া সংযোজন-বিয়োজন করে সরকারকে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট দেওয়ার সম্ভাবনা আছে।
Source: Jugantor