ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

logo

সালেহ উদ্দিন

(২২ ঘন্টা আগে) ২ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:১৪ পূর্বাহ্ন

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত

mzamin

facebook sharing button

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল নেই । নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ২৭টি রাজনৈতিক দলের প্রায় সবদলেই সরকারি দলের  সমর্থিত প্রার্থী রয়েছেন । এসব দল ভোটে নামার আগেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তার আশির্বাদ নিয়েছেন । প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই সাক্ষাতের দলে  দু’জন স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছেন। ওই দুই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকা স্বত্তেও কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশনা গিয়েছে। কিছু আসনে হাইকমাণ্ডের ইশারায় কিংস পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমে পড়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এছাড়া দলের সভাপতির সবুজ সংকেত পেয়ে দলীয় গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে অন্তত ১২৭টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন দলেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী । এদের সকলেই স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। এরা ডামি প্রার্থী হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটের মাঠে মূল প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেছেন।

এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বর্তমান ২৮ জন সংসদ এবং দলীয় জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র (পদত্যাগী) রয়েছেন ৩৫ জন। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী সভায় নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও আমন্ত্রিত হচ্ছেন।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল কে তা নিয়ে সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে।

খোদ  ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। সফরত ইইউ প্রতিনিধিদল নির্বাচনে বিরোধী দল কে হবে তা জানতে চেয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ প্রশ্নের কথা জানালে বিরোধীদল কে তা জানাতে পারেননি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক । ইইউ প্রতিনিধিদল পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জিজ্ঞাসা করেছিলো নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কে ? কি জবাব দিয়েছেন তা তিনিও প্রকাশ করেননি। দেশে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মিলে ৭৩টি রাজনৈতিক দল আছে। এরমধ্যে নিবন্ধিত ২৭টি রাজনৈতিক দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এই ২৭টি দলের মধ্যে ৪ টি দলের (গণফোরাম, বাংলাদেশ জাতীয়পার্টি, মুসলিম লীগ, কল্যাণপার্টির) একটি অংশ নির্বাচনে গিয়েছে। অন্য অংশ বর্জন করেছে। এ হিসাবে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৩টি সম্পূর্ণ ৪টি আংশিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এই দলগুলোর প্রায় সবকটি দলই সরকারি দলের অনুগত। বিভিন্ন সময়ের নির্বাচনে এরা সরকারি দলের সংঙ্গ জোটভুক্ত ছিলো।  এর বাইরে  তিনটি বির্তকিত দল যারা কিংস পার্টি হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন। এই তিনটি কিংস পার্টি -তৃণমূল বিএনপি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি বা বিএসপি।  এ সরকারের নির্দেশনায় এবার নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই দলগলো বিভিন্ন সংস্থার তৈরি বলে বিভিন্ন মহলে জোর আলোচনা আছে। বাকী ২৪টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ বাদ দিলে বাকী ২২টি দলের মধ্যে ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দল রয়েছে ৬টি । দলগুলো হচ্ছে ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। এই দলগুলো সরকারি দলের আদর্শিক জোট হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে রাজনৈতিক তত্পরতা চালাচ্ছে । ১৪ দলীয় জোটের ৩টি দলের জন্য ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই ৬টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রত্যাহার করে তাদেরকে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ১৬টি দলের মধ্যে ৫টি দল- জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, জাকের পার্টি, বিকল্প ধারা ও মিসবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিকভুক্ত ছিলো। সর্বশেষ 

২০১৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটভুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়।  এই দলগুলোর মধ্যে গণফোরাম ছাড়া অন্য দলগুলো ২০০৮  ও ২০১৪ সালেও মহাজোটের শরিক ছিলো।  অবশিষ্ট ১১ টি দলের মধ্যে সরকারপন্থী ৪টি ইসলামী দল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ,

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন । ইসলামী দলগুলোর মধ্যে এই দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। অবশিষ্ট ৭টি দলের মধ্যে ২টি দল- বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি  সরকার বিরোধী ১২ দলীয় জোটে ছিলো। যারাই এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে  যাবে তারাই হবে জাতীয় বেঈমান এই বক্তব্য দেয়ার কয়েকদিন পর কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইব্রাহিম নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশ মুসলিম লীগও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (মতিন) নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এর আগে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ এন এম সিরাজুল ইসলামকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব তফাজ্জল হোসেন যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই এককভাবে যোগ দেন । প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার আইনগত এখতিয়ার তার না থাকলে নির্বাচন কমিশন তার স্বাক্ষরিত  চিঠিতে ৫ জন প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্দ দেন । রাজনীতিতে

বাংলাদেশ মুসলিম লীগও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি(মতিন) নামস্বর্বস্ব পার্টি হিসাবে পরিচিত ।একই অবস্থা কল্যাণ পার্টিরও । পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল ইব্রাহিমের ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা -১৭ আসনে জামানত বায়েজাপ্ত হয়েছিলো । ২০১৮ সালে নিজ এলাকা চট্রগ্রাম-৫ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন । এবারও তিনি এদুটির কোনো একটি আসনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এ দুটি আসনে জাপা এবং আওয়ামী লীগের দুজন হেভিহেড প্রার্থী থাকায় একটি সংস্থার নির্দেশনায় তিনি কক্সবাজার-১ আসন থেকে প্রার্থী হন । কিন্তু ওই এলাকায় তার কোনো পরিচিতি নেই। এ পরিস্থিতিতে তাকে উদ্ধারে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ।

জেনারেল ইব্রাহিমকে জেতাতে প্রথমে ওই আসনের বর্তমান এমপি জাফর আহমেদকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। দিয়েছে ঋণখেলাপি একজনকে। যথারীতি তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। তারপর ভুয়া অভিযোগ তুলে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান আওয়ামী লীগ এমপিকে দল থেকে বহিষ্কার করে। তাতেও আশংকামুক্ত ছিলেন না ইব্রাহিম। ওই আসনে তিনি বহিরাগত। গোটা পাঁচেক কর্মীও নেই তার। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের নির্দেশে জেলা  আওয়ামী লীগ মাঠে নেমেছে। গতবারের প্রার্থীর পক্ষে যারাই দাঁড়াবে ইতিমধ্যে তাদেরই বহিষ্কারের হুমকি দেয়া হয়েছে । স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ইব্রাহিমের পক্ষে কাজ করতে বিভিন্ন সংস্থা ভয় দেখাচ্ছে বলে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে।

অবশিষ্ট ৫টি দলের মধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সপরিবারে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতের পর তিনি সাংবাদিকদের জানান, যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনি তার বোন শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাবেন । গত নির্বাচনে ঋণ খেলাপির কারণে কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়ন বাতিল হয় । খেলাপি ঋণ পূর্বাবস্থায় থাকলেও এবার তার মনোনয়নপত্র রহস্যজনক কারণে বাতিল হয়নি। অবশিষ্ট ৪টি দলের মধ্যে, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি(এনপিপি), বাংলাদেশ কংগ্রেস, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও গণফ্রন্টের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের যারা প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশের কোনো ভোটার  তাদের নাম বলতে পারবে না । ধারণা করা হচ্ছে তাদের সকল প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। এই পার্টিগুলে মূলত বিভিন্ন সংস্থার ইঙ্গিতে পরিচালিত হয়। নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী দলগুলোর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হয়। এই নির্বাচনে মূলত আলোচনা ছিল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে । জাতীয় পার্টি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের শরিক হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। সেই হিসাবে জাতীয় পার্টি  ছিলো সরকারি দলের অংশ। কিন্তু সংসদীয় রীতিনীতি লঙ্ঘন করে প্রধান বিরোধীদলের মর্যাদা পায় জাপা। একই অবস্থা ছিলো ২০১৪ সালের নির্বাচনে গঠিত সংসদেও। ওই সংসদে জাতীয় পার্টির এমপিদের কয়েকজন মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। আবার সংসদের প্রধান বিরোধীদল হয় দলটি। মূলত ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে সমর্থন এবং অনুসরণ করে আসছে। এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে শুরু থেকে রহস্যজনক আচরণ শুরু করে জাপা। একদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে অস্পষ্টতা রাখে অন্যদিকে আসন সমাঝোতা নিয়ে সরকারি দলের সঙ্গে দিনের পর দিন  গোপন বৈঠক করে। দফায় দফায় বৈঠকের পর ২৬টি আসনে দল দুটির মধ্যে সমাঝোতা হয়। সমাঝোতার অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগ ২৬টি আসনে তাদের দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে জাতীয় পার্টির চেয়ে কমসংখ্যক প্রার্থী নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

যদিও জাতীয় পার্টি তাদের ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রত্যাহার দাবি জানিয়েছিলো, কিন্তু এটি করা হলে ওই আসনগুলোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচন হবে এই আশঙ্কায় সরকারি দল রাজি হয়নি। সরকারি দলের হাইকমাণ্ড নির্বাচনে জাপার ২৬জন প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এ দাবি জাতীয় পার্টির নেতাদের। সংসদের প্রধান বিরোধী দল এবং সরকারি দলের আসন সমাঝোতার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ঘটনাকে ভাগাভাগির নির্বাচন বলে সর্বমহলে আলোচনা হচ্ছে।

নির্বাচনে ২৬৫টি আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দেয়। এরমধ্যে ২৬টি আসনে সমাঝোতা হওয়া অবশিষ্ট ২৩৯টি আসনের প্রার্থীরা মূলত ডামি প্রার্থী। এর ফলে ৪/৫ টি আসন ছাড়া অন্য আসনগুলোতে জাপার প্রার্থীরা ভোটের মাঠে নেই। ইতিমধ্যে ৫টি আসন থেকে জাপা প্রার্থীরা ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনে আরেকটি আলোচিত বিষয় হলো-তৃণমূল বিএনপি। তারা ১৩৩টি আসনে প্রার্থী দেয়। এরমধ্যে ১৩০ জন প্রার্থী নির্বাচনে মাঠে সক্রিয় নেই। এই ১৩০ জনের পক্ষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার তাদের মাঠে নামিয়ে এখন আর খোঁজ নিচ্ছেন না। তারা দলের শীর্ষ দুই নেতাকে ‘জাতীয় বেঈমান’ আখ্যায়িত করেছেন। শমসের, তৈমুর ও তৃণমূল বিএনপির নির্বাহী চেয়ারপারসন অন্তরা হুদা দলের তহবিল থেকে টাকা তছরুপ করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। এই পরিস্থিতিতে দলীয় সংকট সমাধান করে নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল বিএনপি যেন সংসদের বিরোধী দল হতে পারে, সে জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন দলটির এই নেতারা। যদিও নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র দাখিলের আগে আগামী সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার দাবি করা দলটি তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। দলটির মহাসচিব তৈমুর আলমের ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপের এক ভিডিওতে দেখা যায়- তিনি কোথা থেকে নির্বাচন করবেন তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন । ইতিমধ্যে সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকার পরও তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীর পক্ষে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রকাশ্যে গণসংযোগে অংশ নেন। তারা জানিয়েছেন দলের হাইকমাণ্ড থেকে নির্দেশনা পেয়েই তারা শমসের মুবিনের পক্ষে নেমেছেন । অন্যদিকে দলটির মহাসচিব তৈমুরের কর্মী-সমর্থকেরা মনে করছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ‘সরকারকে সহায়তা’ করায় আওয়ামী লীগ তৈমুর আলমকে ‘অটো পাসে’ (বিনা ভোটে) সংসদ সদস্য বানাবে। কেউ কেউ আশায় আছেন, ‘গায়েবি’ ভোটে জিতবেন তিনি। সুনামগঞ্জ-৩ আসনে তৃণমূল বিএনপির

আরেক প্রার্থী শাহিনূর পাশা বলেছেন, জোটের কারণে ৩৬ জন মন্ত্রী-এমপি নির্বাচনে পরাজিত হতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ-৩ আসনও (শান্তিগঞ্জ ও জগন্নাথপুর) আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই আসনে নাকি নৌকার ব্যাজ পকেটে লাগিয়ে মানুষ তার সোনালী আঁশ প্রতীকে ভোট দেবেন। আসনটি (সিট) নিশ্চিত করেই তিনি নিজের দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও আলেম-ওলামাদের প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন বলেও জানান। নিবন্ধন পাওয়ার আগে কেউই সুপ্রিম পার্টির নাম জানতো না । কিন্তু কিংস পার্টি খ্যাত দলটি কমিশনের নিবন্ধন পায়। নির্বাচনে ৭৯টি আসনে দলীয় মনোনয়ন দেয় সুপ্রিম পার্টি । বিনিময়ে ১টি আসনে ছাড় পায় দলটি । পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারীকে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। গত  দুটি সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সাইফুদ্দীনেরই চাচা  তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারিকে  ছাড় দেয়া হয়েছিলো । এবার শুরু থেকে খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে এ আসনে নৌকা প্রতীকে দলীয় মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারীর দেখা করার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় । এর পরও তাকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ।

এ প্রসঙ্গে সাইফুদ্দীন মাইজভাণ্ডারীকে সমর্থন দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সমর্থনের বিষয়টি জানিয়েছেন। এখন সেটাই দলীয় সিদ্ধান্ত  হিসাবে ধরে নিতে হবে। এর বাইরে দলীয় প্রার্থী রেখেই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এরা হলেন, কিশোরগঞ্জের  আসনে বিএনপির (বহিষ্কৃত ) মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান ও  সিলেট-৫ আসনে মাওলানা হুসামউদ্দিন। এরা দুজনেই মনোনয়ন পত্র দাখিলের আগে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আশির্বাদ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাসুক উদ্দিন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা ড. আহমদ আল কবিরের কাছ থেকে  সরে যাচ্ছেন  দলের নেতারা। তারা সবাই অবস্থান নিচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হুসামউদ্দিনের সঙ্গে।  জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা ছাত্রলীগ। মাওলানা হুসামউদ্দিনের পক্ষে তারা প্রকাশ্যেই চালাচ্ছেন প্রচারণা। কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পেয়েই তারা দলের প্রার্থীকে বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন। অন্যদিকে  কিশোরগঞ্জ-২ আসনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে

মেজর আখতারের পক্ষে কাজ করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সোহরাব উদ্দিন অভিযোগ করেছেন । বর্তমান এমপি নূর মোহাম্মদসহ আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ মেজর আখতারের পক্ষ নিয়েছেন। এলাকার ভোটারদের মধ্যে মেজর আখতার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন । কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে তার অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এখন পর্যন্ত  জাতীয়তাবাদী আন্দোলন( বিএনএম )  ছাড়া আর প্রায় সবদলকে কিছু কিছু আসনে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মোট ৫৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে বিএনএম) ।এর মধ্যে ছয়জন সাবেক সংসদ সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে জিতিয়ে আনা হবে মর্মে বিএনএমের নেতাদের সূত্রে জানা গেছে।

এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে ডামি প্রার্থী । আওয়ামী লীগ সভাপতির ডামি প্রার্থী রাখার  নির্দেশনা পেয়ে দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী  স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন । কমপক্ষে ১৩০টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে দলের এক বা একাধিক শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮০টি আসনে পরোক্ষভাবে  দলেরই প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে ।

দেশের এই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ডামি প্রার্থী দেয়ার নির্দেশনাই বলে দেয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও কেমন হচ্ছে? ইতিমধ্যে মানবাধিকার এবং অধিকার কর্মীরা এই নির্বাচনকে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন , এটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ভয়াবহ রূপ। এই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে বিরোধীদল যাতে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় না থাকে সর্বপ্রথম তা নিশ্চিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ‘ কিংস পার্টি ‘ তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ বাহিনী এবং আইনশৃঙলা বাহিনীকে দিয়ে মামলা, হামলা এবং গণগ্রেফতার করে প্রধান বিরোধীদলকে মাঠ ছাড়া করা হয়েছে । নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে দণ্ড দিয়ে বিএনপির নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে বিএনপি চাইলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারতো  না। তিনি বলেন, এই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো প্রধান প্রতিপক্ষকে মাঠ ছাড়া করা এবং তারা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তা নিশ্চিত করা । নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরের দৃশ্যমান সকল নির্দেশক অনুযায়ী অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সকল সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নির্মূল প্রায় মন্তব্য করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, নিয়মরক্ষার নামে একতরফা নির্বাচন ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারে, গণতন্ত্র নয়; জনগণের আস্থাও নয়, ভোটাধিকারও নয়। একইভাবে সহিংসতা গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য অর্জনের পথ হতে পারে না। জাতিসংঘের সর্বজনিন মানবাধিকার সনদে নির্বাচন বলতে উপযুক্ত বিকল্প থেকে যথাযথ প্রার্থীকে বাছাই করে নেতাকে বুঝায় । নির্বাচন হতে হবে খাঁটি , সেখানে ভোটারদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকতে হবে; ভয়ভীতিহীনভাবে যথাযথ প্রার্থীকে বেছে নেয়ার সুযোগ থাকতে হবে ; নির্বাচনের পরিবেশ সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান এবং নির্বাচনী প্রচার অভিযানে সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত হতে হবে; গণমাধ্যমের ভূমিকা হবে স্বাধীন এবং ভয়ভীতিহীন। কিন্তু নির্বাচনের যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তার কোনো কিছুই বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত সরকার সমর্থিত দল, কিংস পার্টি, ডামি প্রার্থী, সরকারি জোটের মিত্র এবং দলছুট কতক লোক ছাড়া সরকারি দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতো কোনো উপযুক্ত দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি।