ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি রাষ্ট্রপতি পত্নীর, অধ্যাপক বনেছিলেন শিক্ষকতা ছাড়াই

রেবেকা সুলতানা; বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী এবং ‘ফার্স্ট লেডি’। জীবনবৃত্তান্তের তথ্য মতে—তিনি ১৯৭৬ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন। এরপর ২০০২ সালে বেসরকারি ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) ডিগ্রি নামে আরেকটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বেসরকারি এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন বাতিল করে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।

এরপর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেস্টন ইউনিভার্সিটি’ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের তথ্য উল্লেখ আছে রেবেকা সুলতানার জীবনবৃত্তান্তে। যদিও এমন কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন মুলুকে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন রেবেকা সুলতানা। তখন তার কোনো শিক্ষকতার তথ্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ সরকারি চাকরিতে থাকাকালে ঢাকা জেলার পার্শ্ববর্তী গাজীপুরে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে তখন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। তারই প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি।

নাম-পরিচয় অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার অফিসের সাবেক একজন কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, রেবেকা সুলতানা সরকারি চাকুরি থেকে এসেছিলেন এবং সিনিয়র ছিলেন। ফলে তার বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজ এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা দেখতেন। এ বিষয়গুলো তখন আমরা জানতে পেরেছি। তার পিএইচডি সার্টিফিকেট সংক্রান্ত সমস্যা ছিল—আমরা তখন জানতে পেরেছিলাম।

একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শীর্ষ সাবেক এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, তখন রেবেকা সুলতানাসহ আরও পাঁচ শিক্ষকের সার্টিফিকেট সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে—সার্টিফিকেট বা প্রমাণাদি না পাওয়ায় তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ নিতে আহ্বান জানানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নামের পূর্বে ‘ড.’ ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজেদের সমর্পন করেন।

তথ্যমতে, রেবেকা সুলতানা ২০১১ সালের দিকে নিজেকে প্রভাষক হিসেবে লিখিত দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন বেসরকারি এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরপর চাকরি জীবনের মাত্র ৭-৮ বছরের মধ্যেই তিনি যথাযথ অভিজ্ঞতা ছাড়াই অধ্যাপক বনে যান। মাত্র ৮ বছরের মাথায় কীভাবে কোনো গবেষণা বা প্রকাশ ছাড়াই তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন—তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব হয়নি। অভিযোগ— ‘ভুয়া মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি’ নিয়েই ২০২৩ সালের এপ্রিলের আগ পর্যন্ত রেবেকা সুলতানা প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

সার্টিফিকেট সংক্রান্ত বিতর্ক ওঠার পর শিক্ষকতা করার সময় ২০১৯ সালে রেবেকা সুলতানাকে তলব করে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। তখন তিনি একটি লিখিত বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে তার অবস্থান ব্যক্ত করেন। বিগত ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে নিজের ‘পিএইচডি ডিগ্রি’ গৃহীত হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন রেবেকা সুলতানা।

চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমার পিএইচডি ডিগ্রি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ আট বছর কাজ করছি। আমার নামে ‘ড.’ উপসর্গ ব্যবহার করা হয়েছে এবং আমার নাম লেখা হয়েছে ‘অধ্যাপক ড. রেবেকা সুলতানা’। এখন ‘ড.’ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।’

গত মে মাসে অনুষ্ঠিত এই সভা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড ভেঙ্গে নতুন বোর্ড গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন রেবেকা সুলতানা। ফাইল ছবি।

এছাড়াও বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভুয়া ও অনুমোদনহীন ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) ডিগ্রি দাবি করা এমন আরও পাঁচজন ব্যক্তি তখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ছিলেন। যারা পরবর্তীতে রেবেকা সুলতানার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেন।

প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে তখন উপাচার্য হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, তখন আমরা অনলাইনে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন এমন ছয়জন শিক্ষকের বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারি—অনলাইনে সম্পন্ন ডিগ্রিগুলোর যেসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা তখন ইউজিসিকে জানিয়েছিলাম—বাংলাদেশে অনলাইনে সম্পন্ন হওয়া পিএইচডিগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

শুধু পিএইচডি ডিগ্রি নয়, বিতর্ক রয়েছে এমবিএ নিয়েও। অনুসন্ধান বলছে—ইবাইস ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা পায় বিগত ২০০২ সালে। যেহেতু রেবেকা সুলতানা উদ্ভিদবিজ্ঞানে পড়েছেন, তাই তাকে অবশ্যই দুই বছরের এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছরই তিনি এমবিএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন, বৈধভাবে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে, পিএইচডি ডিগ্রির প্রমাণ সাপেক্ষে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কোনো গবেষণা অভিসন্দর্ভ দেখাতে পারেননি তিনি।

দেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ধরনের প্রকাশনা না থাকলেও অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন কোনো সুযোগ নেই।

দেশের কয়েকটি শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য বলছে—বর্তমানে প্রথম সারির বেসরকারি কোনো উচ্চশিক্ষালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পর সহকারি অধ্যাপক হতে ভালো মানের গবেষণা প্রবন্ধ থাকাসহ ৩ থেকে ৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।

মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলে রেবেকা সুলতানা আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে। এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান পরামর্শক হন এবং নিয়ম ভেঙ্গে ছেলে আরশাদ আদনানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের সদস্য করেন।

এরপর সহযোগী অধ্যাপক হতে আরও ৬ থেকে ৭ বছরের মতো সময় লেগে যায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের। সবমিলিয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেকচারার বা প্রভাষক থেকে অধ্যাপক হতে মোটামুটি ১৫ বছরের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় নিয়মিত গবেষণাও। কিন্তু তার কোনো কিছু ছাড়াই অধ্যাপক বনেছিলেন রেবেকা সুলতানা।

এর আগে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন রেবেকা সুলতানা। তখন তার কোনো শিক্ষকতার তথ্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ সরকারি চাকরিতে থাকাকালে ঢাকা জেলার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

এরপর তার স্বামী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন গত ২০২৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলে তিনি আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে। এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান পরামর্শক হন এবং নিয়ম ভেঙ্গে তার ছেলে আরশাদ আদনানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের সদস্য করেন।

বিষয়গুলো নিয়ে জানতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেও রেবেকা সুলতানার কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এর আগে সার্টিফিকেট সংক্রান্ত ইস্যুতে তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। সব সনদ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেয়া রয়েছে বলেও তখন দাবি করেছিলেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শুভময় দত্তের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

উৎসঃ   দা ডেইলি ক্যাম্পাস