ভুয়া এনআইডির ছবি পাল্টাতে সুপারিশ করেছিলেন আজিজ

ভুয়া এনআইডির ছবি পাল্টাতে সুপারিশ করেছিলেন আজিজ

মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোহাম্মদ হাসান নামে ২০১৪ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছিলেন সাবেক সেনাপ্রধানের এক ভাই হারিছ আহমেদ। ২০১৯ সালে তিনি এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন। আর এই ছবি পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, আজিজ আহমেদের আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ দুটি এনআইডি নিয়েছেন। এর একটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে, তানভির আহমেদ তানজীল নামে। অন্যটি করেছেন তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নামে। আইন অনুযায়ী, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআইডি করা এবং একাধিক এনআইডি করা—দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এখন পর্যন্ত আলোচিত এই দুই সহোদরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

দেশের একাধিক থানা ও আদালতের নথিপত্র, সাজা মওকুফ চেয়ে (জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদনসহ সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে হারিছ ও জোসেফের বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম। কিন্তু হারিছ যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাতে বাবার নাম সুলেমান সরকার এবং মায়ের নাম রাহেলা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ হাসান নামে হারিছ আহমেদের জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কাজটি করে থাকে নির্বাচন কমিশন।

কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনআইডির তথ্য সংশোধন বা ছবি পরিবর্তনের সুযোগ আছে। সাধারণত এ কাজে সময় লাগে। তবে প্রভাবশালী কারও সুপারিশ থাকলে কাজটি দ্রুত হয়। আর কোনো সংশোধনের ক্ষেত্রে কেউ সুপারিশ করে থাকলে কর্মকর্তারা সুপারিশকারীর নাম আবেদনের সঙ্গে রেফারেন্স হিসেবে লিখে রাখেন। ওই আবেদনপত্রটি সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে সুপারিশকারীর নাম লিখে রাখা হয় মূলত পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা হলে যাতে সহজে বের করা যায়, কার সুপারিশ ছিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ছবি পরিবর্তনের আবেদন করেন মোহাম্মদ হাসান (হারিছ)। ওই দিনই ছবি পরিবর্তনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তাঁর আবেদনে রেফারেন্স হিসেবে লেখা আছে—‘জেনারেল আজিজ আহমেদ, সিএএস’। সিএএস হলো চিফ অব আর্মি স্টাফ।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দেওয়া অথবা তথ্য গোপন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে বা জ্ঞাতসারে ওই জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করলে তিনি সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোনো ব্যক্তি পরিচয়পত্র জাল করার কাজে সহায়তা করলে তাঁরও সাজা সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা ভাইয়ের এনআইডির ছবি পরিবর্তনে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ যে সুপারিশ করেছিলেন, তা উল্লেখ রয়েছে আবেদনপত্রে। তবে তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়।

দুটি এনআইডি জোসেফের

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে নিজের নাম ও বাবা–মায়ের নাম বদল করে একটি এনআইডি করেন তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। সেখানে তাঁর ছবি ঠিক থাকলেও নাম লেখা তানভীর আহমেদ তানজীল। বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মিরপুর ডিওএইচএসের একটি বাসার। আর স্থায়ী ঠিকানা ঢাকা সেনানিবাসের একটি বাসার। এনআইডির ছবি তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সশরীর হাজির থাকতে হয়। অসত্য তথ্য দিয়ে এই দুই সহোদরের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করা নিয়ে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

অনুসন্ধানে জোসেফের আরেকটি এনআইডির তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি এনআইডিটি করেছেন ২০১৯ সালে। এখানে তাঁর আসল নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি যে নিবন্ধন ফরম পূরণ করেছিলেন, তাতে তাঁর নাম লেখা হয়েছে—তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ, মায়ের নাম রেনুজা বেগম। তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়েছেন অষ্টম শ্রেণি। পেশা দেখিয়েছেন ব্যবসা।

ওই ফরমে জোসেফ সই করলেও তারিখ উল্লেখ করেননি। তবে তিনি গ্রামীণফোনের ‘০১৩’ সিরিজের একটি মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। সিরিজটি চালু হয়েছে ২০১৮ সালে। ইসি সূত্র জানিয়েছে, তোফায়েল আহমেদ নামের এনআইডিটি ২০১৯ সালে করা হয়েছে।

আর এর আগে তানজীল নামে যে এনআইডিটি নিয়েছিলেন, সেখানে বাবার নাম সোলায়মান সরকার ও মায়ের নাম ফাতেমা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করা হয় স্নাতক।

জাতীয় পরিচয়পত্র করতে এখন ১০ আঙুলের ছাপ ও আইরিশ (চোখের মণির ছাপ) নেওয়া হয়। আগে চার আঙুলের ছাপ নেওয়া হতো। ইসির সার্ভারে এসব ছাপ সংরক্ষণ করা হয়।

এনআইডি দুটি বাতিল করা হয়নি

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তোফায়েল আহমেদ জোসেফের দুটি এনআইডির মধ্যে কোনোটিই গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত ‘লক’ বা বাতিল করা হয়নি। তানজীল নামে তিনি যে এনআইডি করেছেন, সেটি পুরোপুরি সচল আছে। আর নিজের প্রকৃত নাম তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নামে যে এনআইডিটি করেছেন, সার্ভারে সেটা ‘ইনকমপ্লিট’ অবস্থায় আছে। এর অর্থ হলো এনআইডিটি পুরোপুরি সচলও নয়, আবার অকার্যকরও নয়। তবে ব্যাংকসহ ইসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরাসরি তাঁর এই এনআইডির তথ্য পাবে না। কিন্তু ইসির এনআইডি সার্ভারে তাঁর পরিচয়পত্রটি আছে।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র ও ইসি সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সময়ে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে কেউ যদি একাধিক এনআইডি থাকার বিষয়ে এনআইডি শাখায় নির্দিষ্ট তথ্য দেয়, তাহলে সেটা তল্লাশি করে দেখা হবে।

ইসি সূত্র জানায়, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নামে যে এনআইডিটি ২০১৯ সালে করা হয়েছিল, সেটার স্মার্ট কার্ডও প্রিন্ট করা হয়েছে। এটি ইসির মোহাম্মদপুর থানা কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি এই এনআইডিতে তাঁর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের একটি বাসা।

সেনাপ্রধান থাকার সময়েই আজিজ আহমেদের ভাইদের ভুয়া তথ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করানোর ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব খাটানোর বিষয়ে প্রথম আলোসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ দুটি এবং আরেক ভাই আনিস একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন জোসেফ। এ মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এই রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পান।

আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সম্প্রতি এই সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য হয়েছেন।

prothom alo