গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করার পর বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই ঘোষণার পর কিছু মহল মনে করছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে।
২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেন একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। মানবাধিকারকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রেখে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছিল ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন এমন একটি বৈদেশিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা আমাদের কূটনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে একত্রিত করে এবং গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ন রেখে মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে।’ তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনসংক্রান্ত সর্বশেষ বক্তব্য কি বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ?
সম্প্রতি গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছেন, তাতে তিনি বলেন ভোট কারচুপি, ভোটার ও নির্বাচনী এজেন্টদের বাধাদান, নির্বাচনী সমাবেশে হামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা সংবাদমাধ্যমকে তাদের মতপ্রকাশে বাধাদান ইত্যাদি কাজ নির্বাচনে অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মার্কিন সরকার এবং মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ব্লিঙ্কেন তার অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও এ-সংক্রান্ত একটি পোস্ট শেয়ার করেন।
আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিবৃতিকে দেখার চেষ্টা করব।
শুরুতে আমরা বাইডেন প্রশাসনের নেওয়া বৈদেশিক নীতিতে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি সারা বিশ্বে একইভাবে অনুসরণ করা হয় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করব। এরপর আমরা দেখব, ওই বিবৃতি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। পরিশেষে বিবৃতিটি মার্কিন সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, সেই প্রশ্নও আমরা বিবেচনা করব।
প্রথমত, মার্কিন ভিসা নীতির কূটনৈতিক দিকটি বিবেচনা করা যাক। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রাপ্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে অব্যাহতি দেওয়ার পরে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান-এ একজন লেখক লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে মানবাধিকারকে ফিরিয়ে আনার জন্য জো বাইডেনের অদম্য অভিযান বিঘ্নিত হয়েছে, যেভাবে এ ধরনের অভিযান আবার বৃহৎ শক্তির রিয়েল-পলিটিকের ক্ষমতার প্রাচীর দ্বারা বিঘ্নিত হয়।’
‘রিয়েল-পলিটিক’ শব্দটি ১৯৭০-এর দশকে জনপ্রিয় হয়েছিল, যখন হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন মার্কিন মুলুকের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্বরাজনীতি যে নীতিনৈতিকতা মেনে চলতে হবে, কিসিঞ্জার এবং অন্যান্য বাস্তববাদীরা সেটি মনে করেননি। সুতরাং কোনো পশ্চিমা রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থের জন্য সর্বজনীন মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক নীতি যতই লঙ্ঘন করুক না কেন, তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভস প্রথম নীতিটি হলো, সর্বজনীনতার নীতি। এই নীতি নিম্নলিখিত সূত্রটি অনুসরণ করে—‘আপনি সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী এমনভাবে কাজ করুন, যেন আপনার মনে হয় যে সর্বজনীনভাবে কাজটি তেমনভাবেই করা উচিত।’
কিন্তু মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সর্বজনীনতার জন্য কান্টের এই তাগিদ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় পাওয়া যায় না। আমরা তথাকথিত গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধাবাদী আচরণের অনেক দৃষ্টান্ত দেখেছি। এসব ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করাটা হলো নিঃসন্দেহে তাদের জাতীয় স্বার্থ। যেসব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের আওয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও সুবিধা নিয়ে আসতে সক্ষম, সেসব ক্ষেত্রে দেশটি নিজ স্বার্থে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকে।
আর যেসব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি দেশটির কোনো স্বার্থ উদ্ধার না করে বরং সমস্যায় ফেলতে পারে, সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সর্বজনীনতাকে তারা নিমেষেই খারিজ করে দিতে পারে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সুবচন জারি রাখা যুক্তরাষ্ট্রকে একটি হেজেমনিক শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখে, যা এ দেশকে চীন এবং রাশিয়ার ওপর প্রভাব বলয় তৈরি করতে সাহায্য করে। ফলে বিভাজনের দুনিয়ায় উদীয়মান চীন এবং রাশিয়া মার্কিন মুলুকের আধিপত্যের ওপর পাল্টা হুমকি হিসেবে কাজ করছে।
প্রকৃতপক্ষে চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি এককেন্দ্রিক বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, খুব দ্রুতই পৃথিবী একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা দেখবে। সেই সঙ্গে গ্লোবাল সাউথ যেমন—ব্রাজিল ও ভারত আরও ন্যায়সংগত একটি বিশ্বব্যবস্থার দাবি করছে।
আশা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর আধিপত্য ফলাবে না। যেমন ডলারকে তারা একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়া গ্লোবাল সাউথ যুক্তরাষ্ট্রের কপট আচরণে বিরক্ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক পরিচালিত অস্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে ফেক নিউজ ছড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ওপর আক্রমণ করাকে বৈধতা দান করে। বুশ ব্যাবিলনে (ইরাক) বোমা বর্ষণ করে গুঁড়িয়ে দেওয়া।
মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র এই আগ্রাসী যুদ্ধের গালভরা নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’, যা মনে করিয়ে দেয় অরওয়েলিয়ান নিউস্পিক মিনিলাভের (মিনিস্ট্রি অব লাভ) কথা। প্রকৃত প্রস্তাবে, ওরয়েলের বিখ্যাত ১৯৮৪ উপন্যাসে যা ছিল যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের নাম।
সাদ্দাম হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের মিত্র পরবর্তী সময়ে তাদের চোখে একনায়ক হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া বর্তমানের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার মূলে রয়েছে তাদের মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই ৬, যারা ১৯৫৩ সালে ইরানে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত করতে সফল হয়েছিল।
এবার ফিরে যাওয়া যাক মার্কিন-বাংলাদেশ আন্তসম্পর্কের আলোচনায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নতুন ভিসা নীতিকে ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার মার্কিন উপায়’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তারা ‘বাংলাদেশের জনগণ, সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে এটি করছেন’ বলে দাবি করেন।
এক সপ্তাহ আগে পিটার হাসের সহকর্মী আফরিন আক্তার, যিনি মার্কিন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে কর্মরত, সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক কি না, তা নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করছি না, আমরা নির্বাচনী পরিবেশের দিকে বেশি মনোনিবেশ করছি।’
তবে এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি খুব সূক্ষ্মভাবে মোকাবিলা করছে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানে তারা সন্তুষ্ট হয়, তবে বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের ভিসা নীতি ও অন্যান্য অবস্থান-সংক্রান্ত ভিন্ন ব্যাখ্যার দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মোলায়েম করতে পারে এবং বাংলাদেশে কী ঘটছে, তা এড়িয়ে যেতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে ১৯৬৫ সালের মার্কিন অভিবাসন এবং নাগরিকত্ব আইন ছিল একটি অগ্রগামী বিধি, যার লক্ষ্য ছিল দেশটির জন্মের পর থেকে প্রচলিত বর্ণবাদী অভিবাসননীতি দূর করা। ফলস্বরূপ, সেই অভিবাসননীতি এশিয়ানদের অন্তর্ভুক্ত করতে এবং পূর্ব ইউরোপীয় ক্যাথলিক ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধতাগুলো দূরীকরণ আরম্ভ করে।
বাংলাদেশের জন্য নতুন মার্কিন ভিসা নীতি বৈদেশিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি চমৎকার সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে মার্কিন অভিবাসননীতির পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অস্পষ্ট হওয়ার জন্য এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অসাংবিধানিক ঘোষিত হতে পারে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইনগত নীতি লঙ্ঘনের দোষে দুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য।
তবে ক্ষমতায় আসার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয়টি মুসলিম দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এটি ধারণা করা হতো যে বাইডেন প্রশাসনের অভিবাসননীতি তার পূর্বসূরির চেয়ে নমনীয় হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাইডেনের অভিবাসননীতি ধর্মীয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট না হলেও বেশ আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, যা আমাদের অধিকতর মাত্রায় আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
অভিবাসন ও নাগরিকত্ব আইনের ২১২ (ক) (৩) (গ) ধারার অধীনে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতিটি অস্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন অর্থ কী, তা স্পষ্ট নয়। প্রায় এক শতাব্দী আগে কনোলি বনাম জেনারেল কনস্ট্রাকশন কোং (২৬৯ ইউএস ৩৮৫) মামলায় বিচারপতি সাদারল্যান্ড মতামত দিয়েছেন যে একটি ফৌজদারি আইনের শব্দগুলো অবশ্যই যথেষ্ট স্পষ্ট হওয়া উচিত, যেন যেই ব্যক্তিরা এই আইন অনুসরণ করবেন, তারা অপরাধ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন, যার আওতায় তাঁরা পড়বেন। এটি অস্পষ্ট মতবাদ (ভেইগনেস ডকট্রিন) হিসেবে পরিচিত যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের পঞ্চম এবং চতুর্দশ সংশোধনীতে প্রদত্ত যথাযথ প্রক্রিয়া মতবাদ (ডিউ প্রসেস ডকট্রিন) থেকে উদ্ভূত।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য নতুন মার্কিন ভিসা নীতি বৈদেশিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি চমৎকার সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে মার্কিন অভিবাসননীতির পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অস্পষ্ট হওয়ার জন্য এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অসাংবিধানিক ঘোষিত হতে পারে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইনগত নীতি লঙ্ঘনের দোষে দুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য।
- অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন