ভিন্নমত দলনের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশ

  • খন্দকার হাসনাত করিম
  •  ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৭
ভিন্নমত দলনের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশ – ফাইল ছবি

গণতন্ত্রের বৈশ্বিক মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংগঠন ‘ফ্রিডম হাউজের’ পরিচালনাধীন ‘দ্য ফ্রিডম স্কোর’ জরিপের পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার মন্তব্য ছিল- সম্প্রতি বিশ্বে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যাধারী বেশ কয়েকটি দেশ যখন নিজেদের বদনাম ঘুচাতে সমর্থ হয়েছে, তখন বেশ কয়েকটি দেশের বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেশি বেড়েছে। ফলে সেসব দেশে অখ্যাতি ও বদনাম এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ ভিন্নমত দমনের তালিকায় রয়েছে।

বাংলাদেশকে নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকে বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে এবং শাসকমহলের বিপক্ষে বলে যে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, তা রীতিমতো সত্যের অপলাপ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়-ইউনিয়ন বা অস্ট্র্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আগাগোড়াই সোচ্চার। এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রধান কারণ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের অগ্রহণযোগ্য এবং রীতিমতো হরিলুটের ভোট। এ দিনের ভোট আগের দিন দিবাগত রাতে করে ফেলা নির্বাচনী জালিয়াতির একটি ধ্রুপদ বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত, যার কোনো উপমা-উদাহরণ নেই। এভাবে ভোটারবিহীন ‘ভোট’ যে শাসনের নৈতিক বৈধতাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে এটি ভাবার প্রয়োজনীয়তাও শাসকমহল কোনোদিন অনুভব করেছে বলে মনে হয় না। একনায়কদের মধ্যেও এক ধরনের অনুতাপ বা অনুশোচনা সবসময় চেপে রাখতে পারেন না। তাই কিছু কাঠামোগত ও মানসিক সংস্কার উদ্যোগ নেয়া হতে দেখা যায়। উজবেকিস্তানের একনায়ক ইসলাম কারিমভ ও তার পরিবার দুর্নীতির চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করলেও বিরোধী দলের ওপর দলন ও দলনের রুশ দৃষ্টান্ত থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থান করে। এমনকি মিয়ানমারের মতো একটি সামরিক স্বৈরাচারশাসিত দেশেও যেটুকু স্বাধীনতাবিরোধী দলের (বা দলগুলোর) আছে, বাংলাদেশ, সিরিয়া, লিবিয়া, সৌদি আরব, সুদান বা তুর্কমেনিস্তানে সেটিও অবর্তমান।

বাংলাদেশে ‘নির্বাচন’ অত্যাসন্ন। তবে এ পরিস্থিতির জন্য পরিবেশ অনুকূল করার পরিবর্তে যে হারে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর জেল, জুলুম, হুলিয়া ও নজরদারি চালানো হচ্ছে এবং সমন্বয় ও সমঝোতার পথগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে তাতে বিরোধী দল ছাড়া যে এই ‘নির্বাচন’ পার করে নেয়া শাসকদের ঠাণ্ডা মাথার কাজ, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধান বিরোধী দলকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করে শাসকদলের নেতারা বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে যে ‘ক্রুসেড’ চালিয়ে আসছে, তাতে সমঝোতার আন্তরিকতা তাদের মধ্যে যে আছে, তার কোনো লক্ষণ চোখে পড়ে না। কোনো দেশের বিরোধী দলের দুর্গতিতে সমব্যথী হওয়া আর সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা কি এক কথা? তাহলে গোটা বিশ্ব আজ ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে সহানুভূতি দেখাচ্ছে এবং ইহুদি-যুদ্ধবাজদের নির্বিচার শিশুহত্যা, নারীহত্যা বা গণহত্যার নিন্দা জানাচ্ছে, এটিও কি ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হিসেবে বিবেচিত হবে? যে দেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন, বিরোধী দল দমন ও বিরোধী মতামত দলনকে কাঠামোগত রূপ দেয়া হয়েছে, গণতন্ত্রের সেই সঙ্কটকালে সহানুভূতি প্রকাশ ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করার মধ্যে শিষ্টাচার লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ তোলাও গণতন্ত্রের প্রতি রীতিমতো পরিহাস।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে পিডিপির দু’টি ছাড়া অন্য তিনটি দল প্রত্যেকে একটি করে আসনে জয়ী হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন সাতটি আসনে। বাকি ২৮৮ আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে নির্বাচিত হলেও এ ফল সাপেক্ষে বাংলাদেশের প্রথম সংসদ বসে। অন্য দলের প্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবে তাদের আসন হারান এবং অধিকাংশ স্বতন্ত্র সদস্য তাদের আসন ধরে রাখতে একই কারণে ব্যর্থ হন। তবে সেই নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অতীতে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে তাতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ ছিল না। যে দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় সেখানে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না বা তার কোনো সুযোগও নেই। কারণ একটি দলের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ছেড়ে দিয়ে কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রতিযোগিতাবিহীন ভোটের সংস্কৃতির দিকে দেশ আবার ঝুঁকে পড়ছে।

এ প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন রাশিয়াসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর একদলীয় শাসনব্যবস্থাতে সম্ভব; মিয়ানমার বা কঙ্গোর নির্বাচনও এরকম একদলীয়প্রবণ হয় না। গণতান্ত্রিক বিশ্বে তো কল্পনাও করা যায় না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ন্যূনতম ধারণার সাথেও ফল-নির্ধারিত এ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কিভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলা যাবে? যেখানে দলের মনোনয়ন মানে নির্বাচনে ফল শতভাগ, সারা দেশে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক স্রোতের মধ্যে একটিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একদলীয় নির্বাচনী প্রকৌশল দেশের মানুষ ও বাইরের দুনিয়া মেনে নেবে না, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। এভাবে এগুলো দেশের শাসকদের নৈতিক, মানসিক ভিত্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। গণতন্ত্রে বিরোধী দল অনিবার্য ও সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল ছাড়া আইনপ্রণয়ন অবৈধ ও অনৈতিক। কেননা বিরোধিতা ছাড়া সেই আইনসভা নিতান্তই আজ্ঞাবহ এবং রাবার স্ট্যাম্প। বিরোধী দল ছাড়া সংসদে অনাস্থা আনবে কে? সরকারের সমালোচনাই বা কিভাবে। ঘুরে ফিরে তো সেই একদলীয় স্বৈরতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা পেলো।

বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই সেই দেশগুলোর মধ্যে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করতে দেখলে দেশবাসীর কাছে কি তা ভালো ঠেকবে? গণতন্ত্র ও ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের জন্য কি এই গ্লানির বিষজ্বালা সহ্য করা যাবে? ওই তালিকার দেশগুলোর মধ্যে অনেকগুলো অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার। তাহলে সমৃদ্ধি বা উন্নয়নের সাথে গণতান্ত্রিক মর্যাদার স্বীকৃতির এই যে সংঘর্ষ বা অবনিবনা, এর মীমাংস কিভাবে হবে? দারিদ্র্য ও পশ্চাদপদ অর্থনীতির সাথে এ অপবাদ একত্রিত হলে আমাদের অবস্থানকে কি আরো করুণাযোগ্য এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে না? গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকলে আমাদের ভাবমর্যাদা, জাতিসঙ্ঘে ভূমিকা রাখা, স্বল্পোন্নত দেশের রেয়াত বা ছাড় পাওয়া- সবই তো গোল্লায় যাবে। (আমরা যে মধ্যম আয়ের দেশে ওঠার আত্মপ্রসাদ এবং আত্মসন্তুষ্টিতে মেতে আছি, আমাদের অর্থনীতি কিন্তু সে কথা বলে না)। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের যে খাতগুলো (অর্থাৎ জনশক্তি, পোশাকশিল্প ও রফতানি) এর সবগুলো বৈশিষ্ট্য ফিলিপাইন বা শ্রীলঙ্কার ছিল। ¯্রফে ফিলিপাইনের সামরিক শাসন এবং শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের কারণে দেশ দু’টি সেই সুযোগ হারায়। এখন কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক শাসনের অভাবজনিত কারণে আমরাও যে সেই নসিব বরণ করব না, এই গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবে?

খেয়াল করে দেখুন, জাতিসঙ্ঘের তফসিলে এলসালভাদর, নিকারাগুয়া ও ভেনিজুয়েলাকে স্বৈরতন্ত্রপ্রবণ দেশের সারিতে গণ্য করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশ তিনটির তেল আছে, ফসল আছে, রফতানিযোগ্যতা আছে। কাজেই এটি আবারো প্রমাণিত হয়, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি কখনো ‘গণতন্ত্রের’ বিকল্প নয়। মেক্সিকোর অবস্থাও একই। মেক্সিকো গণতন্ত্র পুরোপুরি বর্জিত দেশগুলোর মধ্যে যুক্ত হতে পারে তার মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে। তবে সে পৃথিবীর দ্বাদশতম অর্থনীতির দেশ। হলে কী হবে, গণতন্ত্র নেই বলে তার গ্রহণযোগ্যতা কোথাও নেই। তার দেশের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খড়গ ঝুলছে তো ঝুলছেই। কানাডার মধ্যস্থতাতেও কোনো কাজ হয়নি। মেক্সিকো এখনো গণতান্ত্রিক বিশ্বের চোখে ‘অচ্ছুত’। প্রবৃদ্ধির হার ৩.১ শতাংশ হলেও জিডিপির বহর ১.৮১১ ট্রিলিয়ন ডলার। ওই যে বললাম, অর্থনৈতিক তরক্কি থাকলেও গণতন্ত্রহীন মেক্সিকোর ইজ্জত-সম্মান বিশ্বে তলানিতে।

লেখক : সাংবাদিক ও চিত্রপরিচালক
hasnatkarimpintu@gmail.com