ভারত বিরোধী ক্ষোভ মালদ্বীপে : ঝুঁকিতে  যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ

 

আলফাজ আনাম :

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন প্রগতিশীল জোটের প্রার্থী ও চীনপন্থী নেতা মোহামেদ মুইজ্জু। ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত রান অফ বা দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহকে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। দেশটির নির্বাচন কমিশন মুইজ্জুর জয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইন্ডিয়া আউট’ শ্লোগান নিয়ে নির্বাচন করা মোহাম্মদ মুইজ্জু ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

ভারতপন্থী হিসাবে পরিচিত ইব্রাহিম সোলিহ’র নির্বাচনী শ্লোগান ছিল ‘ইন্ডিয়া ফার্ষ্ট।’ কিন্তু তার অত্যধিক ভারতপ্রীতি জনগণ ভাল চোখে দেখেনি। ফলে নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে তার। আধিপত্যবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী নীতির কারণে দক্ষিন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কমে যাচ্ছে ভারতের প্রভাব। অন্যদিকে শক্তিশালী হচ্ছে চীনের অবস্থান। মালদ্বীপের নির্বাচন তার সর্বশেষ উদাহরণ। দেশটি থেকে বিতাড়িত হতে হলো নরেন্দ্র মোদির ভারতকে।

এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম দফার নির্বাচনে মুইজ্জু ৪৬ শতাংশ ও সলিহ ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কোন প্রার্থীই ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ায়। ফল ঘোষণার পর পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির বা এমডিপির  প্রার্থী মোহামেদ সলিহ। মুইজ্জুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে মুইজ্জুর। তিনি ক্ষমতায় আসায় দেশটিতে চীনের প্রভাব বাড়বে। ৪৫ বছর বয়সী মুইজ্জু বর্তমানে রাজধানী মালের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২১ সাল তিনি পিপিএম জোটের প্রার্থী হিসেবে মালের মেয়র নির্বাচিত হন।

মুইজ্জু এবারের নির্বাচনে শুরু থেকেই ‘ইন্ডিয়া আউট’ শ্লোগান সামনে রেখে তার প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব কমাবেন। এছাড়া দেশটিতে যে অল্প সংখ্যক ভারতীয় সেনা মোতায়েন রয়েছে তাদের বের করে দেবেন। আগামী ১৭ নভেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। ততদিন পর্যন্ত অন্তবর্তী সরকার প্রধান হিসেবে শাসন পরিচালনা করবেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সোলিহ।

১৯৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করা মুইজ্জু স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১২ সালে গৃহায়ন মন্ত্রী হিসেবে তার রাজনীতিতে আগমন ঘটে। ২০১৩ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিন ক্ষমতায় আসার পর তাকে ওই মন্ত্রণালয়েই রাখা হয়। বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে আছে ২০ কোটি ডলারের একটি সেতু নির্মাণ প্রকল্প। এই সেতু রাজধানী মালেকে দেশটির অন্য একটি দ্বীপে নির্মিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রে অবস্থিত মালদ্বীপে দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দিন দিন অঘোষিত লড়াইয়ে রুপ নিচ্ছে। এই দুই বৃহৎ দেশের হস্তক্ষেপের কারণে এক যুগের বেশি সময় ধরে টালমাটাল অবস্থায় চলছে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। মালদ্বীপে অধিকাংশ  সময়ই ক্ষমতায় ছিল ভারতপন্থী সরকার। চীনপন্থী সরকার ছিল মাত্র দুবার।

১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়। সাহায্য চেয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের টেলিফোন করেন। কিন্তু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ছাড়া কেউ সাড়া দেননি। তিনি দ্রুত সেনা পাঠান মালদ্বীপে। তখন থেকেই মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব বাড়তে থাকে।

১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারত মালদ্বীপকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। এছাড়া ভারতই প্রথম রাজধানী মালেতে আবাসিক মিশন খুলেছিল। মালদ্বীপ উপকূল বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নৌপরিবহন রুট। ভারতের বৈদেশিক পণ্য পরিবহনের ৯০ শতাংশই আনা নেয়া হয় এই পথে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানিবাহী সব নৌযান মালদ্বীপ দিয়ে চলাচল করে। জ্বালানীর এই সরবরাহ সুরক্ষিত রাখতে উদগ্রীব বেইজিং। ফলে বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে এই নৌরুটের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা চীন ও ভারত উভয়ের জন্য জরুরি।

কিন্তু ভারতের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা মালদ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ পছন্দ করে না।  বর্তমান প্রেসিডেন্ট সোলিহ’র আমলে দেশটিতে ভারতের প্রভাব অনেক বেড়েছে। ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোই নিয়মিত বলছে একথা। এ কারণে মালদ্বীপের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব দিন দিন জোরালো হয়ে উঠে যার প্রতিফলন ঘটেছে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ক খারাপ হয় মোহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান ও আবদুল্লাহ ইয়ামিন ক্ষমতায় থাকার সময়। এই দুই নেতাই ভারতবিরোধী এবং চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইয়ামিনের পরাজয় এবং ইব্রাহিম সোলিহ’র ক্ষমতায় আসা ভারতকে স্বস্তি এনে দেয়। ইব্রাহিম ক্ষমতায় এসেই প্রথমে ভারত সফর করেন এবং চীনের প্রতি আগের সরকারের কিছু অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে আসেন। তিনি একে বলেছেন ‘ইন্ডিয়া-ফার্স্ট’ পলিসি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে মুইজ্জু’র ‘ইন্ডিয়া আউট’ শ্লোগানের কাছে হেরে গেছে সোলিহ’র ‘ইন্ডিয়া-ফার্স্ট’ পলিসি।

মালদ্বীপের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭২ সালে। তখন থেকেই চীন দেশটিতে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। পরবর্তী সব সরকারের সঙ্গেই তারা সদ্ভাব রেখে চলার চেষ্টা করে। ১৯৮৫ সাল থেকে চীনা কোম্পানিগুলো মালদ্বীপে নানা ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। যদিও মালেতে চীনা দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে মাত্র এক দশক আগে।

মালদ্বীপের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্কের বছরটি আসে ২০১৩ সালে। সে বছর মোহাম্মদ নাশিদকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসেন সাবেক একনায়ক মামুন আবদুল গাইয়ুমের সৎভাই আবদুল্লাহ ইয়ামিন। একই বছর চীনের প্রেসিডেন্ট হন শি জিন পিং। তিনি ক্ষমতায় এসেই তাঁর উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক ট্রান্সপোর্ট করিডর প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই গ্রহণ করেন। পরের বছর শি জিন পিং মালদ্বীপ সফরে যান এবং শ্রীলঙ্কার পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে মালদ্বীপ বিআরআইতে যুক্ত হয়।

ইয়ামিনের চীনঘেঁষা নীতির নয়াদিল্লিকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। চীনকে ঠেকাতে ভারত এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোট কোয়াডে যোগ দেয়। চার দেশের এই জোটের অন্য তিন সদস্য হলো যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান।

গত কয়েক বছরে মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগ বেড়েছে অনেক। এখন পর্যন্ত চীন মালদ্বীপে যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে তার মধ্যে রয়েছে সড়ক ও আবাসন প্রকল্প নির্মাণ।  প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ,  বিদ্যুৎকেন্দ্রে উন্নয়ন, মালে ও হুলহুলের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ। এ ছাড়া মালদ্বীপের পর্যটন ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ করেছে চীন। মালদ্বীপে বিদেশি পর্যটকদের বড় অংশই চীনারা।

বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী যত জোরালো হচ্ছে, ততই মালদ্বীপ উপকূলকে ঘিরে চীন-ভারত ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে চলে আসছে। এ কারণেই মালদ্বীপের আশেপাশের সাগরে দ্রুত নৌশক্তি বাড়াচ্ছে চীন। এর মাধ্যমে তারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই দেশটি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে বের করে দেয়ার যে চেষ্টা করে আসছে তা আপাতত সফল হয়েছে।

২০১০ ও ২০১৩ সালে ভারত মালদ্বীপকে দুটি হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছিল। এরপর ২০২০ সালে তাদেরকে একটি ছোট বিমানও দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, মালদ্বীপে উদ্ধার ও ত্রাণ অভিযান চালাতে এগুলো ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ২০২১ সালে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় যে, ভারতের দেওয়া বিমান চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ৭৫ জন ভারতীয় সেনা সদস্য সে দেশে অবস্থান করছেন।

এরপর থেকেই সোলিহ’র ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পলিসি নিয়ে মালদ্বীপের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। কারণ দিল্লির দেওয়া এই ‘উপহার’কে কেন্দ্র করে সেদেশে ভারতের সেনাদের উপস্থিতি ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। এবারের নির্বাচনে বিরোধী দল ‘ইন্ডিয়া আউট’ শ্লোগান সামনে রেখে প্রচারণা চালানোর সময় তারা মালদ্বীপ থেকে ভারতের সেনাদের চলে যাওয়ার দাবি তোলেন। নির্বাচনে বিরোধী জোটের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহামেদ হুসেইন শরিফ বলেছেন, ‘ভারতের ওপর বর্তমান সরকারের অতি-নির্ভরতার ফলে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব হচ্ছে, এটাই আমাদের প্রধান উদ্বেগের কারণ।’

চীন, ভারতের পাশাপাশি মালদ্বীপ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ থেকে মালদ্বীয অনেকটাই কাছে। দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এ কারণে ক্ষুদ্র এই দেশটির মূল্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র মালদ্বীপের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটা ছিল ভারতের বাইরে কোনো দেশের সঙ্গে মালদ্বীপের প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে চীনপন্থি মুইজ্জু ক্ষমতায় আসায় মালদ্বীপে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক। অনেকে মনে করেন ভারতের প্রভাব বিস্তারের ব্যর্থ চেষ্টা ও ভুল নীতির  কারনে মালদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে।