কাজী জহিরুল ইসলাম
নানা কারণে এখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শীতল। ভারতের কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ প্রতিবেশী দেশটিকে বন্ধু ভাবতে পারছে না। অন্তত পানির হিস্যা নিয়ে ভারত যে আচরণ করছে, সেটিই এর প্রমাণ।
পাহাড়ি ঝরনা যে অসাধারণ ছন্দে সমুদ্রে গিয়ে নামে, সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা অন্যায়। নদীর জন্ম পর্বতে। তখন এর নাম হয় ঝরনা। এই ঝরনাধারা সমতলে নেমে এসে হয়ে যায় নদী এবং সমতলে প্রবাহিত হতে হতে মৃত্যুর জন্য সে খোঁজে উত্তাল সমুদ্রের এক সুবিশাল বুক। পাহাড় থেকে সমুদ্র এই দীর্ঘ পথে নদী প্রবাহিত হবে তার আপন গতি, আপন মহিমা ও আপন ছন্দে। কেউ তাকে বাধা দেবে না। মানুষ নদী সৃষ্টি করতে পারে না। কাজেই কোন অধিকারে সে নদীর গতিপথ বদলাবে; বাধা দেবে? এ কথাগুলো আন্তর্জাতিক আইন নানা ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।
১৯৬৬ সালের আগস্টে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে আন্তর্জাতিক আইন সংস্থার এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার ও বণ্টন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস হয়। নদীর উৎপত্তি যে দেশের পর্বতে, সেই দেশ তার ইচ্ছামতো গতিপথ বদলে দিতে পারবে না; বাঁধ নির্মাণ করতে পারবে না। মূল নদী এবং তার সব শাখা নদী যেসব দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত, সেসব দেশ যেন নদীর পানি যথাযথভাবে পায়, তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলো পারস্পরিক সমঝোতা বা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, প্রয়োজন হলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের ভিত্তিতে ঠিক করে নেবে। অর্থাৎ পাহাড় আমার, ঝরনা আমার, সুতরাং নদীও আমার– মালিকানার এ ধারণা এখানে চলবে না। নদীর গতিপথে কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করতে গেলে, গতিপথ বদলে দিতে চাইলে ভাটির দেশের সম্মতি নিয়ে তা করতে হবে। ভারত থেকে ৫৪টি নদী বাংলাদেশে নেমে এসেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই ৫৪টি নদীর পানি ভারত তার ইচ্ছামতো ব্যবহার করে। যেখানে খুশি বাঁধ নির্মাণ করে; যখন ইচ্ছা বাঁধ খুলে দেয়; যখন ইচ্ছা বাঁধ বন্ধ করে দেয়। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে।
যদি প্রতিটি নদী আপন স্বভাবে তার স্বাভাবিক গতিতে ভারতের পাহাড়-পর্বত থেকে বাংলাদেশে নেমে আসত এবং বাংলাদেশের সমতল চুম্বন করে গিয়ে নামত বঙ্গোপসাগরে, তাহলেও মাঝেমধ্যে, যে বছর অধিক বৃষ্টিপাত হতো সে বছর বন্যা হতো এবং যে বছর কম বৃষ্টিপাত হতো সে বছর খরা হতো। কিন্তু সেই খরা বা বন্যা মোকাবিলায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যেত এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র, প্রশাসন সেই বন্যা ও খরা মোকাবিলার জন্য আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। নানা রকম বাঁধ দিয়ে, কখনও পানি ছেড়ে, কখনও পানি আটকে দিয়ে প্রকৃতির সেই নিয়ন্ত্রণ এখন যেহেতু ভারত তার হাতে নিয়ে রেখেছে, তাই বাংলাদেশ আগে থেকে বুঝতেই পারে না।
১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই মর্মে একটি প্রস্তাব পাস করে, কোনো রাষ্ট্র তার এখতিয়ারের বাইরে এমন কিছু করবে না, যা অন্য রাষ্টের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ভারত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি বৃহৎ রাষ্ট্র। তাদের অনেক কর্মকাণ্ডের প্রভাবই প্রতিবেশী দেশের ওপর পড়ে। কাজেই জাতিসংঘের এ প্রস্তাব অনুযায়ী নদীতে বাঁধ দেওয়ার মতো কাজ তাদের অনেক বুঝে-শুনে, আলাপ-আলোচনা করেই করতে হতো। কিন্তু এসব বিষয়ে ভারত কতটা বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিচ্ছে? ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জাতিসংঘের একটি সম্মেলন হয়, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল মানব পরিবেশ। সেই সম্মেলনে এই প্রস্তাব পাস হয়– কোনো দেশ এমন কোনো কাজ করবে না, যা অন্য দেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের ফারাক্কাসহ সব বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যারা সরকার গঠন করেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে ভারত তোষণ করেছেন; ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। কারণ সামরিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক– সব দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী ও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হয়তো এই ধারণা কাজ করে, ভারত চাইলেই বাংলাদেশের সরকার বদলে দিতে পারে। কিন্তু এ বছরের জুলাই বিপ্লব এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। ভারত তাদের আস্থাভাজন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকার বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে। এই সরকার ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সমমর্যাদার পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাস করে এবং তা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এখন সময় হয়েছে দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা শুরু করার; আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ অনুমোদিত সনদের আলোকে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর গতি-প্রবাহ, বাঁধ ইত্যাদি নতুন করে বিবেচনা করার। যদি ভারত সমমর্যাদার ভিত্তিতে এসব আলোচনায় বসতে না চায় এবং একরোখা নীতি অবলম্বন করে তাহলে সরকারের উচিত হবে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বলা; প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করা।
কাজী জহিরুল ইসলাম: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কবি
samakal