- গৌতম দাস
- ০৮ মে ২০২১
গত ২ মে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস দলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। বিজেপির ৭৭ আসনের বিপরীতে তৃণমূল ২১৩ আসন পেয়ে বিধানসভায় জিতেছে। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি ব্যাপারটাকে যেন ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও সরকারের নির্বাচনের মতো বিশাল গুরুত্বের বানিয়ে ছেড়েছিল। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকায় বিজেপি কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে দুমড়ে মুচড়ে কিভাবে সেই ক্ষমতাকে এক রাজ্যের নির্বাচনে চরম অপব্যবহার করতে গিয়ে হারতে পারে এরই নজির হয়ে থাকবে নির্বাচন।
আরএসএস-বিজেপি এই রাজ্য নির্বাচনকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং এতে সম্ভবত সর্বোচ্চ অর্থকড়ি ও সময় ঢালার পেছনের কারণ কী? ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দিক থেকে বললে ভারত মানে বৃহত্তর উত্তরপ্রদেশের হিন্দু ভারত- এ ভাবনা আধিপত্য চলে আসছে। আর তাই এর সাথে দক্ষিণ ভারতের বিরোধের কথা অনেকে কম বেশি শুনেছেন।
হায়দরাবাদের (বা অন্ধ্রের) পরে তেলেঙ্গানা থেকে কর্নাটক, তামিলনাড়ু হয়ে কেরালা পর্যন্ত এই দক্ষিণী অঞ্চল একে ভারতের ভাষায় দাক্ষিণাত্য (ডেকান) বলা হয়। ভাষার দিক থেকে একে দ্রাবিড়ীয় ভাষার অঞ্চল বলে। এটিই হিন্দিবিরোধী ও আর্যবিরোধী দ্রাবিড় অঞ্চল। আর ১৯৪৭ সালের পর থেকেই এই দ্রাবিড় সমাজ ‘ব্রাহ্মণ তাদের অপ্রয়োজনীয়’ বলে এক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন করেছিল। ব্রাহ্মণ ছাড়াও বিয়ে করা যাবে বলে আইনও তৈরি করেছিল, যা এখনো চালু আছে। এ ছাড়াও ১৯৬২ সালে হিন্দিভাষা চাপানো আন্দোলনে জীবন দিয়ে রুখে দেয়ায় আজো ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই- এমনটি করে রাখা হয়েছে। আর্য-হিন্দির আগ্রাসন একই রকম প্রতিরোধ পেয়েছিল বিহার পেরিয়ে বাংলায় প্রবেশমুখে। তাই বাংলাভাষা টিকে যায়, যদিও প্রাচীন বাংলা অঞ্চলের সেই প্রতিরোধ ভারতের দক্ষিণের মতো প্রবল ছিল না বলে এর প্রচারও কম হয়েছে।
আরএসএস-বিজেপি এবার কলকাতায় রাজ্য নির্বাচনে ‘বাংলা বিজয়ে’ এসেছিল। বিজেপির হিন্দুত্ব বা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্বের জাতিবাদ তারা সারা ভারতে কায়েম করতে চায়। অর্থাৎ এখনকার ভারতের ২৮ রাজ্যের মোট ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠী সনাতন ধর্মাবলম্বী বলা হলেও এরা সাংস্কৃতিক-এথিনিক অর্থে সবাই একই ধরনের হিন্দু নয়। বিজেপির ভাষায় বললে, তারা সব হিন্দুকে রামের অনুসারী হিন্দু বানাতে চায়, এমন এক পরিচয়ে বাঁধতে চায়। এটিই যাতে এক হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্বের জাতিরাষ্ট্র হয়। ভারতের সব রাজ্যের বাসিন্দারা শ্রীরামকে তাদের প্রধান দেবতা মানে না বা তাকে ঘিরে প্রধান দেবতাপূজা বা প্রধান উৎসব উদযাপন করে না; যদিও আবার শ্রীরামকে তারা অমান্য করে ঠিক তাও নয়। অর্থাৎ প্রায় সব রাজ্যেই তাদের নিজস্ব ‘প্রধান দেবতা’ ও সে অনুযায়ী এক প্রধান বার্ষিক উৎসব আছে। ফলে বাংলায় দুর্গা বনাম রামের একটা বড় ভিন্নতা আছে। মনে রাখতে হবে, অন্য কারো দেবতাকে অমান্য করা এর মূল বিষয় নয়। কিন্তু নিজ ভাষা, নিজ শিল্পকলা, নিজ গাথাগল্প সাংস্কৃতিক এ ট্র্যাডিশনে অন্য কোনো রাজ্যের, ন্যূনতম অন্যের হস্তক্ষেপ বা আধিপত্য অথবা ডিকটেট, সামান্য চুল পর্যন্ত কোনো বদল আনা এরা বরদাশত করবে না। এভাবে ‘এথনিক-সাংস্কৃতিক’ অর্থে এবং বাঙালি জাতিবোধ নিয়ে তারা সবসময় নিজের মতো উঠতে চাইবে।
কিন্তু আরএসএস-বিজেপি হলো হিন্দুত্বভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ভারত গড়ে নিজ একক রাজনীতি ও নিয়ন্ত্রণে ভারতকে আনার প্রচেষ্টার দল। তাই আরএসএস-বিজেপি বলা যায়, এই রাজ্য নির্বাচনকে এই প্রথম নিয়েছিল দুর্গার ওপর রামের আধিপত্য কায়েম করা যায় কি না এর উদ্যোগ হিসেবে। মমতার দলের বিজয়ের তাৎপর্য হলো, বাংলা তার দুর্গা আঁকড়ে ধরে বিজেপির হিন্দুত্ব এবং তার রাজনৈতিক ‘রামকে’ পরাজিত করল। এই অর্থে পুরনো আর্য-বাংলা ঐতিহাসিক লড়াইটা আবার বাংলা জিতে রিনিউ করে নিলো।
এ জন্যই বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নির্বাচনে কেবল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাই তৃণমূলকে ভোট দেননি। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান মিলেই কেবল তৃণমূলকে ভোট দেননি। এর সাথে আরো আছে বাঙালি অর্থে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট; এমনকি বিজেপির সমর্থকদের একটা বড় অংশ নিজ দল ছেড়ে মমতাকে মানে ‘এথনিক-সাংস্কৃতিক’ বাঙালির পক্ষে ভোট দিয়েছে বলেই মমতার পক্ষে মোট প্রায় ৪৮.৫% ভোট পড়েছে দেখা যাচ্ছে। এবারের নির্বাচন তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির হিন্দুত্বের আধিপত্যের কাছে নত না হওয়া, হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র গড়ার প্রপাগান্ডার পাল্লায় না পড়া। তারা নিজ বাংলা এথনিসিটির অর্থে জাতি রক্ষার লড়াইয়ে রাজনৈতিক শ্রীরামকে পরাজিত করতে এগিয়ে এসেছে। এই অর্থে বাংলার সাথে লেপ্টে লেগে থেকেছে, তাকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। অথচ ব্যাপারটা হলো, বিজেপির ভাষ্যের এক আর্য-হিন্দির রাজনৈতিক ‘রাম’-এর ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্র; এ নিয়ে জোরাজুরি করাতেই মমতার জন্য অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায় রাজনৈতিক ‘রাম’কে হারানো।
কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করছেন এখন; অনেকে বলছেন এটিই শেষ নয়। আরএসএস-বিজেপির স্টাইল এভাবে হার স্বীকার করে নেয় না। প্রতিশোধ নিতে তারা ফিরে আসে। সাধারণত এরপর আসে মুসলমান হত্যা-নিপীড়ন; অপনেন্টের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হত্যা নিপীড়ন করা। কারণ দেখা যায়, আরএসএস-বিজেপির একটা স্থির ধারণা যে, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় এক চরম মার-হত্যা-নিপীড়ন দাঙ্গা ঘটানো- এই ‘ভয়ের রাজনীতি’ কায়েম করা তাদের শ্রীবৃদ্ধি, সাংগঠনিক বৃদ্ধির প্রধান অস্ত্র ও উপায়। এটি তারা বিশ্বাস করে থাকে। তাই যখনই ভোটে পরাজয় হয় তখনই তারা এ কৌশলের কথা চিন্তা করে। কারণ নিজেদের পরাজয়ের হতাশাকে তারা প্রতিহিংসা দিয়ে পূরণ করে এগোনো সঠিক কৌশল মনে করে।
সর্বশেষ দিল্লির রাজ্য নির্বাচনে সেটি আমরা দেখেছিলাম। সে সময় নাগরিকত্ব ইস্যুতে দিল্লির নির্বাচনে মুসলমানরা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করলে এরপরে দিল্লিতে মুসলমান পাড়াগুলোতে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা ও হত্যা, তথা ম্যাসাকার হয়েছিল। দিল্লির কোর্ট-হাইকোর্ট আজো সেসব মামলায় কোনো প্রতিকার করতে পারেনি। মূল নেতা ‘মিশ্র’ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। বাংলায় মমতার বিজয়ের পরে এ হামলা হবেই এমন বলার কিছু নেই; তবে এটি হবেই না- তা বলাও অবশ্যই ভুল। বরং সব দিকে সচেতন ও সোচ্চার থাকাই সঠিক কাজ।
কিন্তু বাংলাদেশে একটি ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে ‘কেন্দ্রীয় শাসনের হস্তক্ষেপ’ চেয়ে চার-পাঁচজনের এক গ্রুপের মানববন্ধন দেখছি আমরা। অনেকটা ‘হিন্দুদের জন্য হিন্দুরা’- টাইপের যুক্তিতে এসব আজব দাবি; যেখানে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বাংলাদেশের কেউ কোনো পক্ষের নয়। তাই কলকাতার আরএসএস-বিজেপি ঢাকায় এসে ব্যানার নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে দাঁড়ানো- এগুলো কোনো ভালো লক্ষণ নয়। ফলে অবিলম্বে সরকারের এ বিষয়ে সতর্কতা, পদক্ষেপ নেয়া ও নজর দেয়া উচিত। কারণ সবশেষে এরা সবাই নিজেদের সব আকাম কাজের দায় চাপাবে আমাদের সরকারের উপরেই!
এ দিকে আমাদের এক সহযোগী দৈনিকের দিল্লি সংবাদদাতা লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর দলনেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের অভিনন্দন বার্তা যথেষ্ট আগ্রহ সঞ্চার করেছে। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, মোমেনের ওই চিঠি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দলের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধেও এক প্রচ্ছন্ন বার্তা।’ তিনি লিখেছেন এই প্রথম নাকি ভারতে “রাজ্যের নির্বাচনকে ‘ধর্মীয় আধারে’ করার চেষ্টা হয়েছিল। বিজেপি নেতারা ভোট প্রচারে সরাসরি ‘বিভাজনের নীতিকে’ প্রাধান্য দিয়েছেন।”
সরি, আপনার দাবি গ্রহণ করতে পারলাম না। প্রথমত, ‘বিভাজনের নীতিকে’ প্রাধান্য দেয়া অথবা ‘ধর্মীয় আধারে’ ভারতের রাজ্য নির্বাচন বিজেপির এটিই প্রথম নয়। কলকাতা তো বটেই এমনকি রাজস্থানের নির্বাচনেও বাংলাদেশের মুসলমানদের ভারতে অনুপ্রবেশের ভুয়া অভিযোগ তুলে ‘তেলাপোকা’ বলা হয়েছে। আজ হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাওয়ার মতো অনুভব হতে পারে কারো; তবু এসব একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। বিজেপি কখনো কি লুকিয়েছে যে, সে প্রায়ই মুসলমানদের জন্য দাঙ্গা ও হত্যার আজাব হয়ে আসে না? তার দলের রাজনীতি হলো হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব বা হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের রাজ্যগুলোর সবাই প্রধান জনগোষ্ঠী হিসেবে সনাতন হিন্দু বলে পরিচিত হলেও যেকোনো শ্রেষ্ঠত্ববাদী দলের এই কমন ফিচার হয় যে, তারা এক একক পরিচয়ে সবাইকে বাঁধবে- এক জাতশ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করবেই। বিজেপি তো এগুলো লুকায় না! কিন্তু যাদের এসব নজরদারি করার কথা সেই নির্বাচন কমিশন বা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এখানে নজর দিতে রাজি নয়। অথচ ধর্মীয় আধারে ও বিভাজনের নীতিতে ভোট চাওয়া- এটি বিজেপির জন্য দল নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অপরাধ, আর তা তারা করে চলছে। এখন এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা খোদ নিজেদেরই যদি নিজেদের ভারতের নাগরিক নয়, হিন্দু হিসেবে আবিষ্কার ও গর্ব করে থাকেন ও চলেন তবে ভারতের কনস্টিটিউশনে কী লেখা থাকল তাতে কিছুই আসবে যাবে না। উল্লিখিত ব্যক্তির মতো সাংবাদিকের চোখে এগুলো কোনো বড় সমস্যা হিসেবে ধরা পড়বেও না।
উনি আরো লিখেছেন, ‘ভোটে বিজেপির বিপর্যয় ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় সেই স্বস্তির ছোঁয়া স্পষ্টতই পরিলক্ষিত। সেটিই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে আগ্রহ জাগিয়েছে।’
এ কথাতে বলা যায়, সেটি কলকাতায় যা হয় হোক কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এ ছাড়া আর কী বলতে পারতেন? তবে তার অবশ্যই ভারতের কাছ থেকে কোনো কিছু আশা করার মতো বোকামি করার কিছু নেই! আবার এতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রটোকলের যে ব্যত্যয় নেই তা তো কূটিল কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেছেন আর নিজেই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন যে, ‘মোমেনের অভিনন্দন বার্তা কূটনৈতিক প্রটোকলের দিক থেকে নিখুঁত।’
মোদির বিজেপি ভারতে ক্ষমতাসীন আছে ও নির্বাচন করে যাচ্ছে সাত বছরের বেশি ধরে। তিনি যে ‘এক শ্রীরামের নামে’ [শুধু হিন্দু হলে হবে না] এমন এক পরিচয়ে ভারতের সব রাজ্যের হিন্দুকে নিয়ে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র কায়েম করতে চান সেই মেরুকরণ সবসময় করে চলেছেন। কিন্তু সাত বছর ধরে, দেব মুখার্জির মতো অনেকেই ব্যাপারটাকে প্রশ্রয়ের চোখে দেখে এসেছেন।
বরং এই ভারতের সাংবাদিক কূটনীতিক একাডেমিসিয়ানের এক বিরাট কুলের চোখে এখন মোদি ‘বিরাট সফল নেতা’। কারণ তিনি ভারতকে এক ‘পরাশক্তির প্রায় কাছাকাছি’ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। তাই সেই মোদি বাঙালির দুর্গার ওপর ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদী’ চাপালেন কি না বা কোনো ‘ধর্মীয় বিভাজন’ কি না তাতে কিছু আসে-যায় না। মোদি বলছেন, ন্যায়-অন্যায় ইনসাফ বোধ এসব কোনো ভিত্তি নয়। বরং অন্যায়কারী হিন্দু হলেই সে আপনার ভাই, তার পাশে দাঁড়াতে হবে। এই হলো মোদির আরএসএস-বিজেপির রাজনীতি।
মোদির এই রাজনীতিতে যদি কলকাতায় একটি দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করে, তাতে বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন স্বার্থটা উদ্ধার পাবে? নিজেকে রক্ষা পারবে কেন? কার দয়ায়? না, এ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। এ ছাড়া কোনো কেন্দ্র থেকে কোনো মোদি কি তাদের বাঁচাতে আসবেন? আর আমাদের সরকার এ-কোন মোদির ভারতকে করিডোরসহ অসংখ্য সুযোগ সুবিধা খুলে দেবে যে কলকাতায় একটা দাঙ্গা ও হত্যার আয়োজন করতে চায়?
অতএব যেখানে বসে যে যা বলছেন তা চিন্তা করে দায়-দায়িত্ব নিয়েই মুখ খুলবেন- এটিই আমরা আগাম সতর্ক করতে পারি।
বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক শ্রীরাধা দত্ত। এটি আরএসএস-বিজেপির দল ও চিন্তা প্রভাবিত একটি থিংকট্যাংক। সেখানকার শ্রীরাধা বলছেন, ‘ভারতের অঙ্গরাজ্য হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিই প্রধান বিবেচ্য।’
এসব মুখস্থ আপ্তবাক্য ভারতে অনেক লেখা হয়েছে। তাই এসব শুনলে আমাদের অস্বস্তি লাগে। পারলে বিজেপির ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদ’ অথবা ‘ধর্মীয় বিভাজন’ রাজনীতি- এর বিরুদ্ধে লিখুন। পারলে পক্ষেও লিখতে পারেন। কিন্তু চুপ থাকবেন না। এ সময় লিপ সার্ভিস দিয়ে পরিবর্তন আসবে না যদিও বাংলাদেশে আমরা আপনাদের ওপর আশা রাখি না। আপনাদের মোদির ভারতরাষ্ট্র ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদ’ থেকে ‘ধর্মীয় বিভাজন’-এর রাজনীতি করে যাবে আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সব আশা জিইয়ে রাখবেন এটি চলবে না, চলতে পারে না। এসব বোঝা যায় সহজেই।
‘পরাশক্তি’ ভারত
এখন ভারতের সাংবাদিক, কূটনীতিক বা একাডেমিশিয়ানের এক বিরাট দল সব প্রসঙ্গ ছেড়ে মোদিভক্ত হয়ে গেছেন কেন? তারা কিভাবে মোদিভক্ত হয়েছেন? তাতেই বাকি সবাই নিজে নিজেই বুঝে যাবেন।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে করোনা মহামারীতে রোগীদের অক্সিজেনের অভাবে বহু লোকের প্রাণ যাচ্ছে। এতে মোদি যে ‘সরকার চালাতে’ গিয়ে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেছেন- এখানে এসে তা আর কারো থেকে তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। এ ব্যাপারটাকে ‘সরকার চালাতে’ না বলে ফরমাল ভাষায় বলা হয় ম্যানেজমেন্ট ফেইলিওর; এর চেয়ে দুনিয়ায় আর বড় পরাজয় নেই।
ভারতে গত ১৬ বছরের এক ভ্যানিটি বা অহমিকা ভারতের আমলা-রাজনীতিবিদরা চালু করে রেখেছিলেন যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বিদেশী সাময়িক সাহায্য নেয়া যাবে না। কিন্তু কেন কংগ্রেস-বিজেপিসহ সব আমলা-রাজনীতিবিদ সাহায্য না নেয়ার এমন জিদ করেছিলেন? মিলিয়ে দেখুন, ১৬ বছর মানে হলো ২০০৫ সাল থেকে। তার সোজা মানে হলো, বুশের আমলে ভারত যখন চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার থেকে ‘চীন ঠেকানোর’ ঠিকা পেয়েছিল, সে সময়ের সিদ্ধান্ত এটি। ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, এ সুযোগে নিজেকে এক ‘পরাশক্তি’ হিসেবে অসত্য হলেও তুলে ধরবে, দেখাবে। তাই তারা ১৬ বছর আগে দুর্যোগেও বিদেশী সাময়িক সাহায্য নেয়া নিষিদ্ধ করেছিল।
তা হলে এখন সে কথা কেন তুলছি?
কারণ অক্সিজেন সঙ্কটের শুরুতেই মোদি আর (সাহায্য না নেয়ার) ‘ফুটানিকা ডিব্বা’টা বহন করতে রাজি হননি কিংবা বলা ভালো এটিই মোক্ষম সময় যে সুযোগে তিনি ভ্যানিটি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচার সুযোগ নিয়ে ফেলেন। তিনি এবার মোট ২০টি দেশের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেন, যার মধ্যে চীন আছে। এমনকি ক্ষুদ্র ভুটানও।
আর এতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে সাংবাদিক-ইন্টেলেকচুয়ালরা। এ নিয়ে তাদের মনোভাব সবচেয়ে ভালো পাঠ করা যায় দ্যা প্রিন্টে ছাপা এক আর্টিকেলে। ওর শিরোনামটাই তাদের চিন্তা পাঠ করার জন্য যথেষ্ট। ওই আর্টিকেলের শিরোনাম হলো, ‘ভারত কি তৃতীয় বিশ্বফেরত হয়ে গেছে? তামাশাটা হলো, আমাদের পরাশক্তির আকাক্সক্ষা এভাবে কোভিডের হাতে পড়ে ন্যাংটা হয়ে গেল।’
একই মনোভাব ‘হিন্দু’র সুহাসিনী হায়দারের। তিনি প্রায় চ্যালেঞ্জের মতো মোদিকে লিখেছেন তিনি কেন বিদেশী সাহায্য নিতে গেলেন? এভাবে লিডিং সাংবাদিককুলের মধ্যে হতাশার ছায়া নেমে আসতে দেখছি আমরা।
মূল কথাটা হলো, মোদির ‘শ্রীরামের হিন্দুত্ববাদ’ থেকে ‘ধর্মীয় বিভাজন’- এসব দিকের জন্য তারা মোদিকে কাঁধে বসিয়ে তুলে ধরতে কোনোই শরম বোধ করেন না। কারণ এই হিন্দুত্বের মোদি তাদের মিথ্যা হলেও পরাশক্তির স্বাদ চাটিয়েছেন। এখন মোদি সেই মিথ্যা ভ্যানিটিটা কেড়ে ফেলে দেয়ায়ই তাদের এত হইচই।
কাজেই হিন্দুত্ব কলকাতায় মার খেয়ে গেল কি না আর তাতে দিল্লির মতো কলকাতার মুসলমান মারার উৎসব আসন্ন কি না। না এগুলো তাদের অ্যান্টেনার নজরে আসার যোগ্য হয়নি। এই জয় শ্রীরামের জয়জয়কার থেকে ভারতকে কে বাঁচাবে?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]