পি চিদাম্বরম
বিলকিস বানু নামে একজন নির্যাতিত সম্প্রতি যেভাবে তাঁর যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন, তাঁর মতো করে কাছাকাছি সময়ে আর কেউ যন্ত্রণার কথা বলতে পারেননি। কয়েকটি সহজ অথচ হৃদয়বিদারক শব্দে তিনি লাখ লাখ দরিদ্র, বৈষম্যের শিকার এবং নির্যাতিত নাগরিকের অবস্থার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন, ‘আমাকে ভয়ডরহীনভাবে বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দিন।’
বিলকিস বানুর কাহিনি সবাই মোটামুটি জানে। ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গার সময় তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। এ সময় একদল লোক হামলা করে। তাঁকে তারা দলবদ্ধ ধর্ষণ করে। তাঁর তিন বছরের মেয়েসহ তাঁর পরিবারের সাত সদস্যকে তারা হত্যা করে।
ভাগ্যচক্রে তিনি বেঁচে যান। খুনি ও ধর্ষকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবাসীকে নারী শক্তিতে গর্ব করার আহ্বান জানানোর কয়েক ঘণ্টা পরে গুজরাটের সরকার সেই ১১ খুনিকে ক্ষমা করে মুক্তি দেয়।
মুক্ত হওয়ার পর তাদের ফুলের মালা ও মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। অনেকে তাদের ‘সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ’ সম্বোধন করে পা ছুঁয়ে প্রণাম পর্যন্ত করে। ১০ সদস্যের একটি কমিটি এই আসামিদের সাজা মওকুফের আবেদন মঞ্জুর করেছিল। কমিটির সাতজন বেসরকারি সদস্যের মধ্যে (অন্য তিনজন রাজ্য সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন) পাঁচজনই বিজেপির সক্রিয় সদস্য, যার মধ্যে দুজন বিধায়ক রয়েছেন।
২০০২ সালে ওই ঘটনায় বিজেপির কেউ ক্ষমা চায়নি। ২০২২ সালেও তাদের কেউ ক্ষমা চায়নি। বিলকিস বানু প্রাণভয়ে পরিবারসহ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। বিজেপির কেউ তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। এর মধ্য দিয়ে যে বার্তা দেওয়া হলো তা স্পষ্ট। সেটি হলো, আইনের চোখে সব ভারতীয় সমান নয় বা আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী নয়। এই ভারতে সব ভারতীয় ভয়হীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। আদতে ভয়ের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে সব ক্ষেত্রের মানুষ।
এখানে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সাংবাদিকেরা। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে বলেছেন, তাঁদের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলকে সরকারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে চলতে হয়। সরকারের বিরুদ্ধে গেলেই চাকরি যাবে এবং কেউ আর তাঁকে চাকরি দেবে না। তাদের সামনে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, উপস্থাপক ও সম্পাদকের চাকরি যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে।
সরকারি বিজ্ঞাপন রহস্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে বলে মিডিয়া মালিকেরা আতঙ্কে থাকেন। বেসরকারি খাতের বিজ্ঞাপনদাতারা হঠাৎ করে তাদের বিজ্ঞাপন বাজেটে ‘কাটছাঁট’ করবে এমন আশঙ্কা থাকে। এর ওপর নতুন শঙ্কা হলো ‘দখল নেওয়া’।
বিশেষ করে নারী, মুসলিম, খ্রিষ্টান, দলিত, উপজাতি, অভিবাসী শ্রমিক, সমাজকর্মী, লেখক, কৌতুক অভিনেতা, কার্টুনিস্ট, চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং প্রকাশকেরা সব সময় ভয়ে থাকেন। দরিদ্ররা নিরবচ্ছিন্ন মুদ্রাস্ফীতির ভয়ে বাস করছেন। তাঁরা চাকরি হারাচ্ছে। বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। সিএমআইই রিপোর্ট করেছে, ২ কোটি ১০ লাখ নারী ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শ্রমশক্তি থেকে বাদ পড়েছেন।
ব্যাংকাররাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। আমি একজন ব্যাংকারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর ব্যাংকে বড় বড় ক্ষমতাবানের ঋণ নেওয়ার আবেদন এসেছে কি না এবং ব্যাংক সেগুলো অনুমোদন করছে কি না। তিনি আশপাশে তাকিয়ে দেখে নিলেন কেউ শোনার মতো দূরত্বে আছে কি না।
পরে তিনি ফিসফিস করে উত্তর দেন, ‘কেন দিতে যাব স্যার? ঋণ নিয়ে তো ফেরত দেবে না। আমি ছয় মাসের মধ্যে অবসর নেব।’ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কর্মকর্তারা। মোদি সরকারের প্রথম বছরে একজন সিনিয়র অফিসার একটি সভায় সরকারের ভুলত্রুটির বিষয় ব্যাখ্যা করেছিলেন। হঠাৎ করেই তঁাকে বদলি করা হয়। আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের অনেকে অবমাননা এড়াতে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশন বেছে নিয়েছেন।
আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পার্লামেন্ট সদস্যরাও। বিজেপির অনেক এমপি অনানুষ্ঠানিকভাবে একটি বিল বা বিলের কিছু বিধান বা বিরোধী সাংসদের বরখাস্তের বিলের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা সেসব বিলের বিপক্ষে ছিলেন। সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো হলো কৃষি সংস্কার বিল, ফৌজদারি কার্যবিধি (আইডেন্টিফিকেশন) বিল এবং কিছু সংসদ সদস্যকে পুরো সপ্তাহের জন্য বা অধিবেশনের বাকি সময়ের জন্য বরখাস্ত করার বিল।
মন্ত্রীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। মন্ত্রীরা তঁাদের সচিবদের মিলমিশ করে বোঝাপড়া করে নিয়েছেন। সচিবেরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় থেকে প্রতিদিন নির্দেশনা নেন। সেই নির্দেশ অনুসারে ফাইল তৈরি করে মন্ত্রীদের সই নিয়ে নেন।
আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও। এখন আর শুধু সিবিআই, ইডি এবং আয়করের ভয় নয়; বরং জিএসটি প্রশাসন, ডিআরআই, এসএফআইও, সেবি, সিসিআইসহ নানা সংস্থার হানা দেওয়ার ভয়ে থাকতে হয় তাঁদের। অপরাধ, গণপিটুনি, পুলিশের বাড়াবাড়ি ও মিথ্যা মামলার আতঙ্কে বসবাস করছে নাগরিকেরা।
বিশেষ করে নারী, মুসলিম, খ্রিষ্টান, দলিত, উপজাতি, অভিবাসী শ্রমিক, সমাজকর্মী, লেখক, কৌতুক অভিনেতা, কার্টুনিস্ট, চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং প্রকাশকেরা সব সময় ভয়ে থাকেন। দরিদ্ররা নিরবচ্ছিন্ন মুদ্রাস্ফীতির ভয়ে বাস করছেন। তাঁরা চাকরি হারাচ্ছে। বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। সিএমআইই রিপোর্ট করেছে, ২ কোটি ১০ লাখ নারী ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শ্রমশক্তি থেকে বাদ পড়েছেন।
আমি আশা করেছিলাম, সরকারে অন্তত এমন একজন আছেন, যিনি নাগরিকদের আশ্বস্ত করবেন যে তঁারা ভয় ছাড়াই বাঁচতে পারবেন। কিন্তু হায়, আজ ভারতে সে রকম কেউ নেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
- পি চিদাম্বরম ভারতের রাজ্যসভার সদস্য এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী