সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) জানিয়েছে। গবেষণা সংস্থাটিকে উদ্ধৃত করে ইকোনমিক টাইমস বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গেল অর্থবছর শেষে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। তাতে বিদেশি বাণিজ্যের হিস্যা হবে ৪৮ শতাংশ। তবে দেশটির পণ্যের চেয়ে সেবা রপ্তানির পরিমাণই বেশি।
জিডিপিতে বাণিজ্যের হিস্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, ভারত যে বাজার উন্মুক্ত করেছে, এটি তারই লক্ষণ।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ হলেও সেখান থেকে বিপুল আমদানি করে। মূলত ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি এতটা বেশি। এতে সময় ও খরচ দুটোই কম লাগে। তবে ভারত এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম আমদানি উৎস নয়, সেই জায়গা এখন চীনের।
ভারতের পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, চীন, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি।
বাংলাদেশ ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে, গত কয়েক বছরে তাতে বড় পরিবর্তন এসেছে। শুরুর দিকে বাংলাদেশ ভারত থেকে মূলত খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করত। বর্তমান প্রবণতা হলো, কাঁচামাল ও শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রের মতো পণ্য আমদানি করা। এর অর্থ হলো ভারত থেকে বাংলাদেশ যা আমদানি করছে, তার বড় অংশ রপ্তানি খাতে কাঁচামাল হিসেবে কিংবা যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য দেশের রপ্তানির কাঁচামাল জোগাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সেই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২২ সালে ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৭২৩ বিলিয়ন ডলার বা ৭২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে ৪৭ বছর সময় লেগেছে। এরপর তা ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে আর মাত্র পাঁচ বছর লেগেছে। এটি ইতিবাচক বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এদিকে ভারত ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা দিচ্ছে। জিএসটি চালু হওয়ার পর বিভিন্ন রাজ্যে যে ভিন্ন ভিন্ন করহার ছিল, সেই সমস্যা মিটেছে। এখন তা সমন্বিত করহারের আওতায় চলে এসেছে। কিন্তু অশুল্ক বাধা এখনো রয়ে গেছে। সেগুলো বাণিজ্য সহজীকরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানিতে বিলম্ব হয়, এসব সমস্যা ভারতে রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
ভারতের আমদানি
দ্য প্রিন্টের এক খবরে জানা যায়, নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের ওপর ভারতের আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। ২০১২ সালে শীর্ষ ১০টি আমদানি উৎস থেকে ভারত ৫৩ শতাংশ আমদানি করত। ২০২২ সালে যা ৫৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হওয়া সত্ত্বেও চীনের ওপর ভারতের আমদানিনির্ভরতা আরও বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের শীর্ষ ১০ আমদানি উৎসের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। চীন ছাড়া ভারতের শীর্ষ ১০টি আমদানি উৎসের মধ্যে অন্য দেশগুলো হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরাক, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের বাজার বড় হচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সেই সুযোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো সেই সুযোগ নিতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশ আরও কম মূল্যে ভারতের বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারে।
মোস্তাফিজুর রহমানের মত, ভারতের বাজারে শূন্য শুল্ক সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। ভারতের বাজারে যেসব পণ্যের চাহিদা আছে, সেগুলো ওখানে উৎপাদন করতে হবে। শুধু তৈরি পোশাক দিয়ে ভারতের বাজার ধরা যাবে না।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগ—এই তিন ক্ষেত্রের সংশ্লেষ ঘটাতে হবে মত দেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আরও বলেন, সে জন্য নিজেদের সরবরাহ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বাণিজ্যঘাটতি মানেই কি খারাপ
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, বাণিজ্যঘাটতি তেমন একটা উদ্বেগের বিষয় নয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যঘাটতি থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে। আবার চীনের সঙ্গে ভারতের বড় ধরনের বাণিজ্যঘাটতি আছে। ভারত শিল্প কাঁচামালের বড় অংশ চীন থেকে আমদানি করে।
তবে বড় কথা হলো, বাংলাদেশ যে পরিমাণে পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে, তার একটি বড় অংশ রপ্তানি খাতে ব্যবহৃত হয়। তাই এ ধরনের বাণিজ্যঘাটতি উদ্বেগের বিষয় নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
কিন্তু যেসব জায়গায় রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ আছে, সেই সব জায়গায় ভালোভাবে নজর দেওয়া দরকার। বিশেষ করে বাংলাদেশ বিনিয়োগের পরিবেশের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব আইন বা নীতি আছে, সেই সব ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বড় বাধা হয়ে আছে। সেগুলো দূর করে বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে অবকাঠামো, সেবা, পর্যটন, যোগাযোগ ও পরিবহনে ভারতের বিনিয়োগ আনার ওপর জোর দেওয়ার সুযোগ আছে।
রুপিতে বাণিজ্য
গত বছর ডলার-সংকটের শুরু হওয়ার পর অনেক দেশ ডলারকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মুদ্রায় বৈদেশিক বাণিজ্যের চেষ্টা করছে। ভারতও রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এমনকি তারা লিখিত প্রস্তাবও দেবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি যত বাড়বে, রুপিতে বাণিজ্যের সম্ভাবনা ততই বাড়বে। এখন আমরা সেখানে ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি করি। এর বেশি পণ্য আমরা রুপিতে কিনতে পারব না, কারণ রপ্তানি ছাড়ার রুপি পাওয়ার সুযোগ নেই। সে জন্য তিনি অশুল্ক বাধা দূর করে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।
তবে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার আন্তযোগাযোগ বৃদ্ধি করা না গেলে ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও খুব একটা বাড়বে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।