ভারতের আবদারে রামগড়ে স্থলবন্দর

সোহাগ কুমার বিশ্বাস,

পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির শেষপ্রান্তে রামগড় উপজেলা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সীমান্তের এই উপজেলাটি ক’বছর আগেও ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পাহাড়ের পাদদেশে ফেনী নদী ভাগ করেছে দুই দেশের সীমানা। সীমান্তের ওপারে ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে পরিচিত সিকিম, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ডের অবস্থান।

তবে রামগড় সীমান্ত লাগোয়া এলাকাটির নাম ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম। এই সাবরুমকে কেন্দ্র ধরে সাম্প্রতি সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে কানেক্টিভিটি বাড়িয়েছে ভারত। তাদেরই আগ্রহে রামগড়ে বন্দর তৈরি করে দিচ্ছে বাংলাদেশ। ফেনী নদীর ওপর তৈরি মৈত্রী সেতু সংযোগ ঘটিয়েছে দুই দেশের। এই সেতু দিয়েই বাণিজ্যিক ও প্যাসেঞ্জার পারাপার হবে বন্দরের কার্যক্রম চালু হলে।

ভারত প্রান্তে সবকিছু প্রস্তুত হলেও এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। বন্দর ভবন, কাস্টমস শেড, প্যাসেঞ্জার ও পরিবহন টার্মিনালসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে এরই মধ্যে। বাকি ৩০ শতাংশের কাজও চলমান রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুনে প্যাসেঞ্জার ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হবে স্থলবন্দরটি।

তবে বরৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত চার লেইনের মহাসড়কটি পুরোপুরি শেষ হতে আরও ২/৩ মাস বেশি সময় লাগবে। এতবড় কর্মযোগ্য চললেও বাংলাদেশিদের মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই নতুন এই বন্দরটি নিয়ে। কারণ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ এই বন্দর তৈরি করে দিলেও লাভের ১৬ আনাই পাবে ভারত। বিএনপি সরকার আমল থেকেই রামগড় ও সাবরুমের মধ্যে বন্দর তৈরির আগ্রহের কথা জানিয়ে এলেও একতরফা লাভের এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।

২০০৮ সালে ১/১১ সরকারের সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে গিয়ে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর ব্যাপারে যৌথ সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছরেরই ৭ নভেম্বর রামগড় শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার।

কিন্তু বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ট্রানজিট সুবিধা চালু হওয়ার পর। ২০১৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ নামে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির ভিত্তি প্রস্তরের ফলক উন্মোচন করেন। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতুটি ২০২১ সালের ৯ মার্চ দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন।

রামগড় স্থলবন্দর প্রকল্প

বাংলাদেশ রোড কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট (বিআরসিপি) নামে তিনটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। যার একটি অংশ করছে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে। অন্যটি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। ১১শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বারৈয়ারহাট থেকে হেঁয়াকো হয়ে রামগড় পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরি করছে সওজ। আর দুটি প্যাকেজে বন্দর সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো নির্মাণ করছে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রথম প্যাকেজটিতে স্টিল স্ট্রাকচারের চারতলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন ও দোতলা ইমিগ্রেশন ভবন, পোর্ট বিল্ডিং, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, রেস্ট হাউজ ও মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৯ কোটি টাকা। মাসুদ স্টিল নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজ বাস্তবায়ন করছে।

ফেনি নদীর পরিত্যক্ত জমিতে আরসিসি ঢালাই দিয়ে মাটি ভরাট করে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ, ইয়ার্ড তৈরিসহ ৯৩ কোটি টাকার ভূমির মানোন্নয়নে কাজ করছে মেসার্স মনিকো ইঞ্জিনিয়ারিং নামের আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দুটি প্যাকেজই খাতা-কলমে ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। টাকার সংস্থান ঠিকঠাক থাকলে আগামী জুনের মধ্যেই প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

একই প্রকল্পের অংশ হিসেবে রামগড় থেকে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত চার লেইনের মহাসড়ক তৈরি করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ৩৮ ফুট প্রস্থের ৩৮ কিলোমিটার লম্বা এই সড়কটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ২৪৯.২০ মিটারের ৯টি সেতু ও ১০৮ মিটারের ২৩টি কালভার্ট। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১শ’ কোটি টাকা।

যার মধ্যে উন্নয়ন তহবিল থেকে ৫১৩ কোটি ৭ লাখ টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাকি ৫৯৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ক্রেডিট অব লাইন বা এলওসি-৩ পদ্ধতিতে ঋণ দেবে ভারত সরকার। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে এমন শর্তে ১ শতাংশ চড়া সুদে বাংলাদেশকে এই লোন দিয়েছে ভারত। বর্তমানে এই প্রকল্পের ৩৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। যা বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অশোকা বিল্ডকন লিমিটেড।

সরেজমিনে যা দেখা গেছে

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহাসড়কের বারৈয়ারহাট থেকে বাম দিকে ৩৮ ফুট প্রশস্ত আরেকটি মহাসড়কের কাজ চলছে। সমতলের এলাকাটি কার্পেটিং হয়ে গেছে, পাহাড়ি দুর্গম এলাকাগুলোতে নির্মাণ কাজ চলমান। ছোট ছোট কয়েকটি ব্রিজ-কালভার্টও হয়ে গেছে। তবে বড় ব্রিজগুলো এখনো হয়নি। কোথাও মসৃণ আবার কোথাও কাজ চলমান থাকায় খানাখন্দে ভরপুর এই মহাসড়ক ধরে ৩৮ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই রামগড় বন্দর। তার কয়েকশ’ গজ আগে বসানো হয়েছে ওজন স্কেল।

বাণিজ্যিক কার্যক্রম কবে শুরু হবে তার ঠিক নেই কিন্তু ওজন স্কেল তৈরি করা হয়েছে বহু আগে। ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মৈত্রি সেতুর বামপাশে নির্মিত হচ্ছে ইমিগ্রেশন ভবন ও প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল। তার পেছনে ট্রাক টার্মিনাল, অফিস ভবন, রেস্ট হাউজ ও মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে। রাস্তার পাশে সামনের দিকে টিনসেডে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী ইমিগ্রেশন শেড।

জুলাই মাসে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে এই টিনসেড ঘরটি তৈরি করে বন্দরের কার্যক্রম শুরু করার তৎপরতা শুরু করেছিল পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার। ১৪ আগস্ট প্রাথমিকভাবে প্যাসেঞ্জার পারাপারের মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু করার দিনক্ষণও নির্ধারণ করেছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত ভারতের আস্থাভাজন সরকারের অবস্থা নড়বড়ে দেখে ভারতের তাগিদেই এই অস্থায়ী শেড তৈরি করে বন্দরের কার্যক্রম আরম্ভ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো। এই শেডেই বসে অফিস করেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এখানেই দেখা হয় পোর্ট ইনচার্জ আমান উল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানান, তড়িঘড়ি করে ১৪ আগস্ট প্যাসেঞ্জার পারাপারের তাগিদ থেকেই রাস্তা ও ফুটপাতের জন্য নির্ধারিত জমির ওপর বিশাল এই ইমিগ্রেশন সেডটি তৈরি করা হয়েছিল। সরকার পতনের পর সেই প্রক্রিয়া থমকে গেছে। তাই সামনের বড় এই শেডটি ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে। বন্দর চালু না হলেও ৫ জন স্থায়ী ও ৮ জন আউট সোর্সিং কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া স্কেল পাহারার জন্য ১১ জন গার্ডকে নিয়োগ করা হয়েছে কয়েক বছর ধরে।

একতরফা লাভ ভারতের

আসামের গোহাটি ও ত্রিপুরার আগরতলা সেভেন সিস্টারের মূল বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সবচেয়ে নিকটতম মূল শহরগুলোর মধ্যে কলকাতা। শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে গোহাটি কিংবা আগরতলার দূরত্ব ১ হাজার ৬শ’ থেকে ১ হাজার সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটারের মধ্যে। তাও দুর্গম ও পাহাড়ি পথ। যেসব পথে ছোট আকারের পরিবহন চলাচল সম্ভব হলেও ভারী পরিবহন চলাচল একেবারেই অসম্ভব।

বিপরীতে রামগড় হয়ে আগরতলার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৩শ’ কিলোমিটার। আর গোহাটির দূরত্ব ৬০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। রামগড় বন্দর হয়ে ট্রানজিট সুবিধা পেলে বিচ্ছিন্ন এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে স্মুথ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে ভারতের। আর এই কারণেই ছোট্ট এই বন্দরের প্রতি এত আগ্রহ তাদের। ফেনী নদীর ওপর নিজস্ব অর্থায়নে ১৩৩ কোটি টাকা খরচ করে ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছে দিল্লি। রামগড় থেকে বারৈইয়ারহাট পর্যন্ত রাস্তা বানানোর খরচের প্রায় অর্ধেকের যোগানও দিয়েছে দেশটি। তবে এই টাকা চড়া সুদে নিয়েছে বাংলাদেশ। সরকার পতনের আগে বন্দর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজগুলো ভারতের আগ্রহে বেশ জোরেশোরেই হয়েছে। এখন কিছুটা ধীরগতিতে হলেও কাজ চলছে।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধায় তামাবিল, আখাউড়া ও রামগড় বন্দর দিয়ে পণ্য নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে ভারত। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তামাবিলের দূরত্ব ৪শ’ কিলোমিটারের কাছাকাছি। আখাউড়াও ২শ’ কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু রামগড় মাত্র ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফলে বন্দর চালু হলে একচেটিয়া ট্রানজিট পণ্য পরিবহন হবে চট্টগ্রাম-রামগড় রুটে।

রামগড়ের স্থানীয় ব্যবসায়ী রুবেল বড়ুয়া জানান, বন্দর তৈরির আগে এলাকার উন্নয়ন, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশসহ নানা স্বপ্ন দেখিয়েছিল বিগত সরকার। কিন্তু দিন দিন সেসব স্বপ্ন ফিঁকে হয়ে আসছে। কারণ মূলত বন্দরটি ব্যবহার হবে ভারতের ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের জন্য। এসব পণ্য লোড-আনলোডের ব্যবস্থা হলেও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হতো এখানে। কিন্তু ট্রানজিটের শর্ত অনুযায়ী পণ্য সরাসরি ঢুকে যাবে ভারতে। তাই হাতে গোনা নামমাত্র মাশুল ছাড়া কোনো লাভই নেই বাংলাদেশের।

এছাড়া বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল সীমান্ত এলাকায় বসবাস করা রামগড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন বিশ্বাস করছেন না একেবারেই। কারণ বাপ-দাদার আমল থেকে সীমান্তে বসবাস করার সুবাদে সেভেন সিস্টারের মানুষের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়েছে তার। সেখানকার অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্গতি না থাকাসহ পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক কারণেও মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ডের বাসিন্দারা পর্যটনে উৎসাহী নয় বলে জানান তিনি। তার দাবি বিগত সরকার মিথ্যা সম্ভাবনার গল্প শুনিয়ে মূলত ভারতকে খুশি করতেই বন্দরের নামে ভারতের পণ্য পরিবহনের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।

বাংলাদেশ অংশে বিনিয়োগের সুযোগ কম

বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার এলাকা। এর মাঝামাঝি স্থানে হেঁয়াকো বাজার। হেঁয়াকো থেকে করেরহাট পর্যন্ত রিজার্ভ ফরেস্ট অর্থাৎ বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনের মধ্যে কোনো স্থাপনা বা কলকারখানা গড়ে ওঠার আইনগত সুযোগ নেই। এছাড়া রামগড় থেকে সোনাইখোল পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চল।

শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী পার্বত্য এলাকায় বাইরের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে বারৈয়ারহাটের পরে এই এলাকাগুলোতে চাইলেও বড় কোনো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বিনিয়োগ করতে পারবে না। ফলে স্থলবন্দরকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় শিল্পায়নের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল আগের সরকার তার পুরোটাই মিছে।

ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্য

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, একটি দেশ অন্য একটি দেশকে বাণিজ্যিকভাবে ট্রানজিট সুবিধা দিতে হলে তার বেশকিছু লাভ-লোকসানের চিন্তা করতে হয়। বিশ্বব্যাপী ট্রানজিটগুলো এভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের লাভ চিন্তা করেনি বিগত সরকার। ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত রাজ্যগুলোর সঙ্গে তাদের প্রধান রাজ্য এমনকি রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম নেই বললেই চলে।

আর এই কারণেই সীমান্ত ঘেঁষা এই ৭টি রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্যের বড় বাজার রয়েছে। বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট, ঢেউটিন, স্টিল, শুটকি, সুপারি, বেকারি আইটেম ও বাংলাদেশে উৎপাদিত দেশি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সেখানে। ট্রানজিট সুবিধা পুরোদমে চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে এই রাজ্যগুলোতে ভারতীয় পণ্য একচেটিয়াভাবে প্রবেশ করবে। এতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সবদিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ট্রানজিটের শর্ত ও মাসুলের দিকটি পুনর্বিবেচনা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

একই সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এখনই ধারণক্ষমতার বেশি পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল করছে। মিরসরাই ইকোনমিক জোন চালু হলে যানবাহনের চাপ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। তার ওপর ট্রানজিটের পণ্য পরিবহন শুরু হলে রাস্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। যা সামলানো কঠিন হবে বলেও মনে করেন মাহফুজুল হক শাহ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদ উল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, রামগড় থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। তাই এই এলাকাটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি। ভারতের জন্য চিকেননেক যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য রামগড়ও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট্ট এই এলাকাটি দখল নিতে পারলে পুরো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

তাই রামগড় বা ফেনী এলাকায় একটি কমপোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে বহু আগে থেকেই আছে। কিন্তু নানা কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো বাণিজ্যিক সুবিধার নামে ট্রানজিট দিয়ে এলাকাটিকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। কারণ কন্টেইনারের ভেতরে কী পরিবহন করা হবে তা সব সময় পরীক্ষা কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ফলে এই বন্দর চালু হলে দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ জানান, বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য স্থলবন্দরের চেয়ে রামগড় স্থলবন্দর ব্যতিক্রমী। এটিই দেশের একমাত্র এবং প্রথম ট্রানজিট বন্দর। এ ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ সুস্পষ্ট। কারণ এই বন্দর চালু হলে ভারতের উত্তর-পূর্ব সাতটি রাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্সে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থিক নেতৃত্ব নিশ্চিত হবে।

বিশেষত, উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যোগাযোগ বিঘ্নের জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতে আসতে পারেনি এতদিন। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ রামগড় স্থলবন্দর দিয়ে সহজে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিয়ে শিল্পায়ন ও তাদের পণ্যের দ্রুত ও সুলভ চলাচল সম্পন্ন করতে পারবে। ভারতের সুবিধাগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রগুলো সীমিত। এতে বাংলাদেশ আরও বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য

রামগড় স্থলবন্দর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম জানান, বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনার কাজ গড়ে ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে অন্তত ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করে কার্যক্রম চালু করার টার্গেট রয়েছে তাদের। তিনি জানান, ভারতের পীড়াপীড়িতে গত ১৪ আগস্ট ইমিগ্রেশন সেবা চালুর মধ্য দিয়ে যাত্রী পারাপার শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছিল আগের সরকার।

সে সময় ইমিগ্রেশন শেড ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি দেখতে ভারতের একটি প্রতিনিধি দল রামগড়ে এসেছিল। তারা জানিয়েছে, ভারত অংশে সব কাজ বহু আগেই শুরু হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে সেভেন সিস্টারে কয়েক বিলিয়ন ডলার দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তুতি রয়েছে ভারত সরকারের।

বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় মহাসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জাহেদ হোসাইন জানান, রামগড় থেকে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত সড়ক তৈরির কাজ ৩৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও বনবিভাগসহ বেশ কয়েকটি দপ্তরের অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শুরুতে কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল।

সেগুলো এখন কেটে গেছে তাই আগামী জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি। বড় এই প্রকল্পের বাইরে একই এলাকায় জাইকার সহায়তায় ২৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ ও এসব ব্রিজ কালভার্টের আগেপরে ২শ’ থেকে ৩শ’ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক তৈরির আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ওই কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এই ব্রিজ-কালভার্টগুলোও বন্দরের কাজে ব্যবহৃত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here