ভারতীয় কর্ষিকায় আবদ্ধ বাংলাদেশ

মাহমুদুর রহমান

কয়েকটা দিন অসুস্থ থাকায় সম্পাদকীয় লেখা সম্ভব হয়নি। আজ খানিকটা সুস্থ বোধ করায় কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। লেখার শিরোনামে বাধ্য হয়েই একটা কঠিন, কম প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে। আসলে ইংরেজি ‘TENTACLES’ এর আর কোন সহজ বাংলা আমার জানা নাই। ‘কর্ষিকা’ শব্দের অর্থ হল, কোনো প্রাণীর দীর্ঘ শুঁড় যা দিয়ে তারা শিকার ধরে। উদাহরণ স্বরূপ, অক্টোপাস, জেলি ফিস, মাকড়সা কিংবা কাঁকড়া বিছার কথা বলা যেতে পারে। এরা যখন সেই কর্ষিকা দিয়ে শিকার পেঁচিয়ে ফেলে তখন কর্ষিকা কেটে ফেলতে না পারলে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুই শিকারের অবধারিত নিয়তি। একবার পেঁচাতে পারলে পালিয়ে যাওয়ার আর তেমন সুযোগ থাকে না। অক্টোপাসের মতই বাংলাদেশের সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছে হিন্দু ভারতের বিষাক্ত কর্ষিকা। কেমন করে সেই কর্ষিকা দিয়ে উপমহাদেশের একেবারে পূবে অবস্থিত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটির প্রাণশক্তি শুষে ফেলা হচ্ছে সে বিষয়েই আলোকপাতের চেষ্টা করবো আজকের সম্পাদকীয়তে।

শেখ হাসিনাকে ভারত ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসিয়েছে এটা পুরনো কথা যা সবাই জানে। যেটা দুর্ভাগা বাংলাদেশের ইতিহাস অসচেতন জনগণ জানেনা অথবা জানলেও তার পরিণতি বুঝতে অক্ষম তা হলো গত তের বছরে ভারতীয় কর্ষিকা কেমন করে, কোন রূপে, কাদের দ্বারা, কতখানি বিস্তৃত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদ এবং সংস্কৃতি দিয়ে শুরু করি। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদ ছড়ানোর প্রধান দায়িত্ব ইস্কনের উপর। এটা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ’র ব্যক্তিগত প্রজেক্ট। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির তাত্ত্বিক সংগঠন হল আরএসএস। যে সব দেশে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করা রাজনৈতিক কারণে সম্ভব হয় না, সেখানে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য ইস্কন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এক সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এই প্রকল্পের অঘোষিত বাংলাদেশি প্রধান ছিল। সেই জোরেই তার ধারনা হয়েছিল ক্ষমতার প্রতিযোগীতায় শেখ হাসিনার সাথে সে টক্কর দেয়ার ক্ষমতা রাখে। শেষ পর্যন্ত এস কে সিনহাকে পরাজয় মানতে হয়েছিল। তিনি সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলতেন যে, শেখ হাসিনার এবং আমার ক্ষমতার কেন্দ্র একই জায়গায়। এস কে সিনহার শেষ রক্ষা হয় নাই। তার চেয়ে ভারতের হাসিনাকে কেন বেশি প্রয়োজন ছিল সেটা যেহেতু আজকের বিষয়বস্তু নয় তাই ওই আলোচনা অন্যদিন। বর্তমানে ইস্কনের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক চট্টগ্রামের একসময়ের মাফিয়া ডন মহিউদ্দিন চৌধুরির ছেলে, ফ্যাসিস্ট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল। ইস্কনের কাজ হচ্ছে বিশেষভাবে স্কুলে কোমলমতি বালক-বালিকাদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদের আদর্শ ও তত্ত্ব ছড়িয়ে দেয়া। এর সুদূরপ্রসারী ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সেই পাকিস্তানি আমল থেকে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগতে থাকা বাঙ্গালী মুসলমান এখনো উদাসীন। দেশের শিক্ষা উপমন্ত্রীকে ইস্কনের দায়িত্ব বুঝেশুনেই দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রী দিপুমনিও ইসলাম বিদ্বেষের জন্য সুপরিচিত। ভবিষ্যত প্রজন্মকে হিন্দুত্ববাদি আদর্শে গড়ে তোলা হচ্ছে আর এ যুগের পিতামাতারা অন্ধের মত কেবল অর্থের পেছনে ছুটছেন। সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশকে ভারতভূক্ত করার লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে জনগণের মধ্যে হিন্দু সংস্কৃতি প্রচার ও ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মিডিয়া, এক শ্রেণির শিক্ষক এবং সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর। প্রথম আলো গ্রুপসহ আওয়ামী মিডিয়া, ড: জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির, সুবর্ণা মুস্তফা গং এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এর সংগে ভারতের স্টার জলসা ইত্যাদি চ্যানেলগুলোর পরিপূরক ভূমিকা তো আছেই।

এবার প্রশাসনের দিকে নজর দিচ্ছি। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সচিবালয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই কাজ করছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র”। এসব জায়গায় পদোন্নতি নির্ভরই করে ইসলাম বিদ্বেষের মাত্রার উপর। বিশেষত: গুরুত্বপূর্ণ পদে সেক্যুলার কিংবা নাস্তিক হওয়া যথেষ্ট নয়। নাস্তিকতার সঙ্গে সেই কর্মকর্তা প্রবল ইসলামবিদ্বেষী হলে তবেই কেবল সিনিয়র পদে বিবেচিত হবে। সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া মাত্রই ‘র’য়ের নজরদারি শুরু হয়ে যায়। প্রথম পরীক্ষা, অফিসারটি মদ পান করে কিনা। মদ্যপানের অভ্যাস না থাকলে তার পক্ষে মেজরের উপরে পদোন্নতি প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয় পরীক্ষা, নামাজ পড়ে কিনা। নিয়মিত নামাজ তো দূরের কথা, যে কেবল জুমার নামাজও পড়ে তার রিপোর্টও জায়গামত নেগেটিভ হয়ে যায়। তৃতীয় পরীক্ষা, স্ত্রী কতখানি আধুনিক। পোষাক হলো সেই আধুনিকতার মাপকাঠি। অফিসারের স্ত্রীর শালীন পোষাক হলেই রিপোর্ট নেগেটিভ। দিল্লিতে নিয়মিত এই জাতীয় প্রতিবেদন পাঠানো ডিজিএফআই এর গোয়েন্দাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হলো মৌলিক পরীক্ষার অন্তর্গত। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে আওয়ামী পরিবার থেকে এলেও তথাকথিত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীতে হাসিনার আমলে প্রমোশন মিলবে না। তাহলে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কী ধরনের সেনাবাহিনী অফিসার শ্রেণি তৈরি করা হচ্ছে। জেনারেল পর্যায়ের প্রতিটি প্রমোশনে দিল্লি এবং ভারতীয় হাইকমিশন সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। সচিবালয়েও একই অবস্থা। সেখানে প্রমোশন বাণিজ্যেও ভারতীয়দের জন্য এখন ভাল পার্সেন্টেজ আছে। অতএব, ঢাকায় পোস্টিং এর জন্য দিল্লিতে রীতিমত কাড়াকাড়ি। এক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জেনেছি, বাংলাদেশে পোস্টিং পাওয়ার জন্য ভারতের সিভিল সার্ভিসে শুধু মেধার প্রতিযোগিতাই হয় না, ঘুষও লেনদেন হয়। ঢাকায় পোস্টিংকালে প্রভুর মত থাকার পাশাপাশি বেশুমার অর্থ উপার্জনেরও সুযোগ রয়েছে। এছাড়া, দিল্লির প্রশাসনে এখন অনেকটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হতে গেলে তার অবশ্যই বাংলাদেশে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সর্বোচ্চ পদে প্রমোশনের হাতছানি, বিপুল অংকের ঘুষপ্রাপ্তি ছাড়াও বাংলাদেশে এলে নানারকম ব্যবসায়েও যুক্ত হওয়া যায়। ভারতীয় মন্ত্রী এবং কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসায় অংশীদারিত্বের আলোচনা আজকাল সর্বত্র শোনা যায়। ঢাকা সেনানিবাসে ওপেন সিক্রেট যে, সাবেক সেনাপ্রধান ও আলজাজিরার অল দি প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান এর নায়ক জেনারেল আজিজের ব্যবসায়িক পার্টনার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতি প্রভাবশালী আমলা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে হাজার বছরের পরিক্রমায় বিকশিত বাঙ্গালী মুসলমানের সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়কে ভারতীয়করনের যে কাজ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে শুরু হয়েছিল তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটেছে গত তের বছরে। বাংলাদেশ সারা দুনিয়ায় বর্তমানে ভারতের একটি অঘোষিত উপনিবেশ হিসেবেই পরিচিত। এই মেকি স্বাধীনতার জন্য দেশের জনগণ সশস্ত্র সংগ্রাম করে নাই। আমাদের নির্লিপ্ততা এবং ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় কর্ষিকা বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হলেও পাশের শত্রুর বিরুদ্ধে এক নতুন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি এখনও সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তবে তার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মুক্তিকামী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিষাক্ত কর্ষিকাগুলো কেটে ফেলতে হবে। আর দেরি নয়। ২০২২ সাল হোক বাংলাদেশের মুক্তির বছর। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।

সম্পাদক, আমার দেশ