৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর ভারতীয় ঋণে চলমান একটি প্রকল্পের কাজ এখন থেমে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করার এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তারা কাজ ফেলে রেখে দেশে ফিরে গেছেন। তাঁরা কবে ফিরে আসবেন, তার ঠিক নেই। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত বিদ্যমান সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। একবার সংশোধনের পর প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) থেকে এই অর্থ দেওয়া হচ্ছে। বাকি ২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা দেবে সরকার। ২০২৫ সালের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। যদিও চলতি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ঠিকাদার হাওয়া
সদ্য পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ গভীর ছিল। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতের এক্সিম ব্যাংক লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) দিয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় এলওসির মাধ্যমে আশুগঞ্জ–আখাউড়া সড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়। ভারতীয় ঋণপুষ্ট প্রকল্পের নিয়ম হলো ভারতীয় ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হয় এবং ভৌত প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা সে দেশ থেকে কিনতে হয়।
একনেকে পাসের পর ২০১৮ সালে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজের সব কটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদেরকে দেওয়া হয়। করোনার কারণে ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে তেমন একটা কাজ হয়নি। ২০২২ সালে প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়। স্থানীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের পাশাপাশি তিন শর মতো ভারতীয় নাগরিক এই প্রকল্পে কাজ করতেন।
কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সবকিছু বদলে যায়। পরদিনই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার তাদের সব ভারতীয় কর্মীকে প্রকল্প এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। পরে তাদের নিজ দেশ ভারতে নিয়ে যায়। বেশির ভাগ কর্মী আখাউড়া-আগরতলা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান বলে জানা গেছে। এখনো তাঁরা কাজে যোগ দেননি।
এ বিষয়ে প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. শামীম আহমেদ বলেন, ‘৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সব কর্মী ভারতে চলে গেছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে নিরাপত্তাসংক্রান্ত সবুজ সংকেত পেলেই কেবল কাজে ফিরবেন।’
প্রকল্পের বিভিন্ন জিনিসপত্রও এখন অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এদিকে অর্ধসমাপ্ত কাজের জন্য জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে। মহাসড়কের এক পাশে খানাখন্দ থাকায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল করতে হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এতে যানচালক ও যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে।
প্রকল্প পরিদর্শন করবে আইএমইডি
এক মাস ধরে কাজ বন্ধ থাকায় মাঠের পরিস্থিতি জানতে শিগগিরই প্রকল্পটি পরিদর্শনের পরিকল্পনা করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ইতিমধ্যে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটির মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়নের কী সমস্যা, তা জানার জন্য পরিদর্শন করা হবে। পরিদর্শনের পর পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভারতীয় ঋণের অনিশ্চয়তা
এদিকে ভারতীয় ঋণের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চলমান প্রকল্পের পাশাপাশি যত প্রকল্প প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর যৌক্তিকতা যাচাই–বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। ভারতীয় তিনটি এলওসির চলমান এবং প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোও মূল্যায়ন করা হবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এলওসির আওতায় চলমান ও প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ ভারতীয় স্বার্থেই নেওয়া হয়েছে। যেমন আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত চার লেনের সড়ক প্রকল্পটি ট্রানজিটের আওতায় ভারতীয় পণ্য আনা–নেওয়াতেই বেশি কাজে লাগবে।
ভারত ২০১০, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তিনটি এলওসিতে বাংলাদেশকে মোট ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতির পরও কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থছাড় হয়নি। সর্বশেষ হিসাবে সব মিলিয়ে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৮০ কোটি ডলার।
তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে এ পর্যন্ত ৩৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি শেষ হয়েছে। চলমান আছে আটটি প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ কিংবা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।
prothom alo