মাহমুদুর রহমান
আমার বৃদ্ধ বয়সের পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আধিপত্যবাদ বা হেজেমনি (The Rise of Indian Hegemon in South Asia and Security of Small States)। থিসিস লেখা শেষ করেছিলাম ২০২২ সালের মাঝামাঝি যখন বাংলাদেশে একবিংশ শতকের দুনিয়ায় সবচেয়ে নৃশংস শাসক, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দোর্দণ্ডপ্রতাপে ১৮ কোটি জনগণের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেজে বসেছিলেন। অতি সংক্ষেপে আমার গবেষণার উপসংহার ছিল নিম্নরূপ:
১। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হওয়া মাত্র ভারত এই অঞ্চলের উপর একচ্ছত্র প্রভুত্ব (Complete Hegemonic control) কায়েম করবার প্রচেষ্টায় নেমে পড়ে।
২। পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল হলেও ভারতের উপরোক্ত বাসনায় প্রধান আঞ্চলিক (Regional) বাধা রূপে আবির্ভূত হয়। অঞ্চলের বাইরে থেকে (Extra-regional) চীনও ভারতের অভিলাষ পূরণের পথে অতি শক্তিশালী হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
৩। শ্রীলংকা, নেপাল, আফগানিস্তান, এবং মালদ্বীপে ভারতীয় আধিপত্যবাদ পরাজিত হয়েছে।
৪। এই অঞ্চলে ভারত শুধুমাত্র ভুটান এবং বাংলাদেশে প্রভুত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে। ভুটানের ক্ষেত্রে ১৯৪৯ সালে সম্পাদিত এক চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লির সর্বময় কর্তৃত্ব অদ্যাবধি বজায় আছে। যে কারণে আজ পর্যন্ত ভারত ভুটানকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, এবং ফ্রান্স) কারো সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয় নাই। অপরদিকে বাংলাদেশের সাথে ভুটানের মত কোন আনুষ্ঠানিক আধিপত্যবাদী চুক্তি (Hegemonic Treaty) না করেও ভারত ২০০৯ সালে একটি চরম অত্যাচারী পুতুল সরকার বসানোর মাধ্যমে প্রভুত্ব কায়েম করতে পেরেছে।
আগস্টের মহান বিপ্লবে বাংলাদেশের লড়াকু ছাত্র-জনতা অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথার মধ্য দিয়ে ভারতের পুতুল সরকারকে বিতাড়িত করেছে। খুনী ফ্যাসিস্ট হাসিনা জনরোষ থেকে পালিয়ে তার প্রভু ভারতের কোলেই আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিহাসের নির্মম পরিক্রমায় যে দিল্লি থেকে ১৯৮১ সালে পতিত একনায়ক শেখ মুজিবের দুই কন্যা বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন কার্যকর করতে এসেছিলেন তেতাল্লিশ বছর পর সেই কন্যাদ্বয়কে অবমাননাকরভাবে দিল্লিতেই ফিরতে হয়েছে। শেষ অবধি বিলম্বে হলেও বাংলাদেশের মানুষ জেগেছে। তবে এর মধ্যে দিল্লির তাবেদার হাসিনা বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করে গেছেন।
বিচার বিভাগকে এমনভাবে ধূলিস্যাৎ করেছেন যে এর প্রতি জনগণের কোন আস্থা নাই। সেই ২০১০ সালে “স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা” শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখে দীর্ঘদিন ডিবি এবং র্যাবে রিমান্ডে টর্চার সহ্য করে জেলে যেতে হয়েছিল। আজকের বিপ্লবের তরুণ নায়করা সেই সব কাহিনী হয়ত জানেই না। পুলিশকে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত খুনী বাহিনী রূপে নির্মমভাবে ব্যবহার করার ফলে অতি প্রয়োজনীয় এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছে আজ চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। ষোল বছর ধরে মিডিয়ার লজ্জাকর স্তাবকতার ফলে রাষ্ট্রের কথিত চতুর্থ স্তম্ভের কোন বিশ্বাসযোগ্যতা অবশিষ্ট নাই। সর্বব্যাপী দলীয়করণ ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়ে বেসামরিক প্রশাসনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। ভুয়া উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রকে এমনভাবে ঋণগ্রস্ত করা হয়েছে যে, ড: ইউনুসের সরকারের প্রতি আমার একরকম করুণাই হচ্ছে। পতিত সরকার প্রণীত বাংলাদেশের কোন পরিসংখ্যানেরই কোনরকম বিশ্বাসযোগ্যতা নাই। ২০১৮ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এবং আইএমএফ জাতীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে আমি নিয়মিত চিঠি লিখে শেখ হাসিনার দুর্নীতি এবং ভুয়া পরিসংখ্যানের বিষয়ে সতর্ক করেছি। তাতে অবশ্য কোন কাজ হয় নাই। আমার সাবধান বাণীকে তারা উপেক্ষা করে গেছেন। আমি জানিনা, বাংলাদেশে এই সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরাও শেখ হাসিনার দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিনা। না হলে বছরের পর বছর তারা মিথ্যা পরিসংখ্যান গিলেছেন কি করে? তারা নিশ্চয়ই সব নির্বোধ নন।
এখন প্রশ্ন হলো যে, ভারত কি এমন বিপর্যয় নীরবে হজম করবে? নিরস্ত্র জনগণের বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতন এবং পলায়ন দিল্লির জন্য নিছক এক কূটনৈতিক পরাজয় নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্যবাদী দেশটির সবচেয়ে বিপর্যয়কর কৌশলগত পরাজয় (Strategic Defeat)। ১৯৮৯ সালে শ্রীলংকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়ও বাংলাদেশের বিপ্লবের কাছে ম্লান হয়ে গেছে। তরুণ বিপ্লবীদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, তারা কোন বিদেশী শক্তির সহায়তায় এই বিপ্লব সংঘটিত করে নাই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য নেয়ার কাফফারা আমাদের ৫৩ বছর ধরে দিতে হয়েছে। একদিকে ডান বাম নির্বিশেষে, দেশটির প্রতিটি রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, এমনকি তথাকথিত পণ্ডিতরাও সর্বক্ষণ আমাদেরকে ১৯৭১ এর কাহিনী স্মরণ করিয়েছে এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে চুষে খেয়েছে ও আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। এবার বিশ্বের কোন প্রান্তের কোন মোড়লই কোনরকম সাহায্যের দাবী করতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি কপচিয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রশ্ন ভারতের ইচ্ছার কাছেই নতি স্বীকার করেছে। ফ্যাসিবাদের শিকল থেকে জনগণের মুক্তি জনগণই আবু সাইদের মত অসীম বীরত্ব দেখিয়ে শাহাদাত বরণ করে আদায় করে নিয়েছে। করো কাছে কোন কৃতজ্ঞতার ঋণ আর আমাদের পরিশোধ করতে হবে না।
আন্তর্জাতিক মন্ডলে ড: ইউনুস মার্কিনঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। এবারের বিপ্লবের নায়কও তিনি কিংবা কোন সুশীল নন। ড: ইউনুস কখনও বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এমন কোন ঘটনা আমার অন্তত স্মরণে পড়ছে না। তিনি হাসিনার গুম খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন নাই। অপ্রকাশ্যে তিনি কি করেছেন তা জনগণের অজানা। ভারতের নোবেল বিজয়ী বাঙ্গালী অমর্ত্য সেন কিন্ত, মোদির হিন্দুত্ববাদ এবং দু:শাসন নিয়ে সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। তবুও আমরা ড: ইউনুসের উপর আস্থা স্থাপন করতে চাই যে, এবার অন্তত তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। জনগণের বিপ্লবের তিনিই সবচেয়ে সুবিধাভোগী। বাংলাদেশের জনগণের কাছে তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সরকারের এক সপ্তাহের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত একতরফা ভারতীয় চুক্তিসমূহ সম্পর্কে ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে আমরা কোন মন্তব্য পাই নাই। ভারতীয় অক্টোপাসের কব্জা থেকে মুক্তি কিভাবে ঘটবে জনগণকে সাথে নিয়ে তার কৌশল প্রণয়নের দাবী করে আজকের সম্পাদকীয় শেষ করছি। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ