ভারতকে ‘বিদ্যুৎ করিডর’ নয়

ভারতের বাঁধে ভাটির বাংলাদেশ খরায় শুকায়, বর্ষায় হঠাৎ বানে ভাসে

ভারতের বাঁধে ভাটির বাংলাদেশ খরায় শুকায়, বর্ষায় হঠাৎ বানে ভাসে। অতিবৃষ্টির পর বন্ধ বাঁধগুলো হঠাৎ যখন একসঙ্গে খোলা হয়, তখন ভরাট হয়ে পড়া নদীগুলো পানি ধারণ করতে না পেরে বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। নতুন পানি এলে পুরোনো পানি আগাম ছেড়ে না দিয়ে বাঁধের গেটগুলো শেষ মুহূর্তে খোলা হয়। আবহাওয়া স্যাটেলাইটের কল্যাণে ব্যাপক বৃষ্টি হবে জেনেও কয়েক দিন আগে থেকেই উজানের বাঁধের পানি রিলিজ বা ড্রেনেজের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

দুটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের পানি প্রত্যাহার বাঁধে বা জলবিদ্যুৎ জলাধারগুলোতে কী পরিমাণ পানি আছে, আর বৃষ্টির পূর্বাভাসের মতে কী পরিমাণ নতুন পানি আসবে। এই দুই তথ্যের গাণিতিক মডেলিং করে জানা যাবে কী পরিমাণ পানি কত আগে থেকে ছাড়তে হবে। ভাটির বাংলাদেশে নদীর পলিপতন ও অটেকসই উন্নয়নের কারণে নাব্যতা পরিস্থিতি বদলায়। সেই পরিস্থিতি বিচার করে কী পরিমাণ পানি প্রতি ঘণ্টায় বের করে দেওয়া যাবে, তা হাইড্রোলজিক্যাল মডেলিং সফটওয়্যারে বসালে, কত দিন আগে কতগুলো জলকপাট খুলে বঙ্গোপসাগরে পানি নিষ্কাশন করা লাগবে, সেটা বেরিয়ে আসবে।

অর্থাৎ ভারতের জলধারণ সক্ষমতা একই রেখে আগাম পানি নিষ্কাশন করে হঠাৎ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। এই যুগে সারা বিশ্বেই পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় হাইড্রোলজিক্যাল মডেল ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তির সহায়তায় আগাম পানিনিষ্কাশন পরিকল্পনা ভারত কেন করছে না, এই প্রশ্ন কূটনৈতিকভাবে তোলা যায়। ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা অববাহিকার বাঁধ, গজলডোবাসহ বরাক অববাহিকার বাঁধের সব গেট একসঙ্গে না খোলার বিষয়টি দ্রুত সুরাহা হওয়া দরকার। শুষ্ক মৌসুমের পানি বণ্টনই ভাটির দেশের মানুষ ও প্রকৃতির একক চাহিদা নয়, বানে ভাসানোর ক্ষতির অবসানও দরকার। আধুনিক কারিগরি পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি নদী অববাহিকায় সম্ভাব্য বৃষ্টির আন্তর্দেশীয় পরিমাপ নিয়ে সহনীয় পানি ছাড়া ও ড্রেজিং পরিকল্পনা করা যায়। সে জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা।

হিমালয়ান বেসিনে বর্ষার বিপুল জলরাশি বঙ্গোপসাগরে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট পরিবেশবান্ধব, চাষাবাদবান্ধব মডেল তৈরি করা জরুরি। তা করা না গেলে ভাটি অঞ্চলে ধান, সবজিসহ সমুদয় খাদ্যবাজারের অস্থিরতা কখনোই কাটবে না। শুষ্ক মৌসুমের পানিশূন্যতা আর বর্ষায় বানে ভাসানো—বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দুটি বড় ঝুঁকি। প্রতিবছরে এ কারণে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে।

২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংগৃহীত বন্যার প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির বিবরণে ৫ হাজার ৯৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৬ টাকার হিসাব দেওয়া হয়েছে। (সূত্র: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, আন্তমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থাপিত বন্যা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র, ২৫ আগস্ট ২০২০)। অন্যদিকে ২০২২ সালে ১৮টি জেলায় ফসল, গবাদিপশু এবং অবকাঠামো—সব মিলিয়ে আনুমানিক মোট ক্ষতির পরিমাণ ৮৬ হাজার ৮১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বণিক বার্তা জুলাই ২৫, ২০২২)।

আগস্ট ২০২৪ বন্যায় তিন জেলায় অর্ধলাখ গবাদিপশুর প্রাণ নিয়ে গেছে বন্যা, হাজার হাজার ঋণগ্রস্ত খামারির স্বপ্ন বন্যায় ভেসে গেছে। ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, প্রায় ২৪ লাখ ১২ হাজার ৩৯৬টি পশুপাখি মারা গেছে। এই অভাবনীয় ক্ষতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এমন বন্যা ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক সভ্যতা বলা যায় না। বাংলাদেশে আগস্ট ২০২৪-এর বন্যায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অতিবৃষ্টিতে যখন সব নদী পানিতে পরিপূর্ণ, ভারত বাংলাদেশকে আগাম তথ্য এবং সতর্কতা না দিয়েই ত্রিপুরার ডম্বুরসহ বিভিন্ন বাঁধ ও জলাধারের কপাট ছেড়ে দিয়েছিল। এতে ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কয়েক বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো এবং সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ডম্বুর লেকের পানি ধারণক্ষমতা শূন্য দশমিক ২৩ ঘন কিলোমিটার। এই পরিমাণ পানি হঠাৎ উন্মুক্ত করা পানিবোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো বিষয়। কয়েক বছরে ধরেই এ ধরনের ঘটনা ফারাক্কায় হচ্ছে, গজলডোবায় হচ্ছে।

এক ঘন কিলোমিটারের চার ভাগের এক ভাগ পানি দিয়ে যদি এ রকম সর্বনাশা দুর্যোগ ঘটানো যায়, তাহলে যেসব বাঁধের ধারণক্ষমতা এক ঘন কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি অথবা কয়েকটি বাঁধ সম্মিলিতভাবে কোনো এক বর্ষার রাতে যদি বাংলাদেশের ওপর কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়া খুলে দেওয়া হয়, তাহলে কী ঘটতে পারে একটু কল্পনা করুন। যত দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশের উজানে ভারত তত বাঁধ তৈরি করছে।

ভুটানের পূর্ব দিকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ। যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) নদীর শতকরা ৬০ ভাগ পানি অরুণাচল প্রদেশ থেকে আসে। ২০১৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কারিগরি টিম প্রতিবেদন অনুযায়ী, অরুণাচল প্রদেশে ভারত সরকারের ১৫৪টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর সক্ষমতা প্রায় ৫৭ গিগাওয়াট। এসব প্রকল্প থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে বিদ্যুৎ পরিবহন করে নেওয়ার জন্য একাধিক উচ্চক্ষমতার বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হবে। এখানেই ভারতের বাংলাদেশকে দরকার।

চিকেন নেক (শিলিগুড়ি করিডর) শিলিগুড়ি শহর বিভিন্ন সড়ক, পানির খাল এবং অনেকগুলো বৈদ্যুতিক লাইনের কারণে ইতিমধ্যে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। সেখানে নতুন করে উচ্চক্ষমতার বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করতে গেলে সমস্যা। দোকলাম ভ্যালিতে আছে চীনা সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। সে বিবেচনায় বৈদ্যুতিক গ্রিডের গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চালন লাইন শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে বানানো ভারতের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এই ব্যাকবোন লাইন বানালে ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৫০টি আন্তসীমান্ত নদীর ৫৪টিই বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবাহিত। আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে নদীগুলোর ওপর ভারত একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি আটকে বা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজ করছে। বাংলাদেশের উজানে যত বাঁধ ভারত তৈরি করবে, এমন কাজ আরও বাড়তে থাকবে। ভারতকে বৈদ্যুতিক করিডর দিলে বাংলাদেশের উজানে পরিকল্পনাধীন অনেক বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারতের বিভিন্ন সংস্থা বিনিয়োগ জোগাড় করতে পারবে। এমতাবস্থায় ভারতকে বৈদ্যুতিক করিডর নির্মাণ করতে সাহায্য করা বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী একটা সিদ্ধান্ত।

ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মাণ ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশের কূটনৈতিক, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি অঙ্গনে জোর প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন ছিল। তার বদলে ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে ভারতকে বিদ্যুৎ করিডর দেওয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ চলেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কর্মকর্তা করিডর লাইনের ডিজাইন ঝুঁকি এবং ফিজিবিলিটি স্টাডি সামনে আনলে তাঁরা বদলি এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের এই ভারতকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা জরুরি।

এই মুহূর্তে বরনগর-পার্বতীপূর-কাতিহার ৭৬৫ কেভি সঞ্চালন লাইন নামক এই করিডর লাইন নির্মাণের নকশা প্রণয়নের জন্য পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি পরামর্শক নিয়োগ করেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া লাইনটির পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রণয়নের জন্য পাওয়ার সেলে আরেকটি পরামর্শক নিয়োগের কার্যক্রম চলমান আছে। অধিকতর গবেষণা এবং নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-পরিবেশগত পুনর্মূল্যায়নের আগে এসব উদ্যোগ বন্ধ হওয়া চাই।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক [email protected]
  • prothom alo