ড. মাহফুজ পারভেজ
(৩ সপ্তাহ আগে) ৫ নভেম্বর ২০২২, শনিবার
সঙ্কটে সাধারণ মানুষ বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরণের দিকনির্দেশনা পাওয়ার জন্য। কিন্তু তখন যদি শীতল রক্তের প্রাণীর মতো বুদ্ধিজীবীগণ শীতঘুমে তলিয়ে যান, তা হলে সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। সমাজে, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তখন উপচে পড়ে।
কিন্তু একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী আর সাধারণ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে বিস্তর তফাত আছে। হাতের নাগালে কাগজ আর কলম থাকলেই যেমন লেখক হওয়া যায় না, তেমনিভাবে অন্যায়, অচলাবস্থা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনের সাহস না থাকলে নিজেকে বুদ্ধিজীবী বলে নৈতিকভাবে দাবি করা যায় না।
বিশেষত যখন সমালোচনা অত্যন্ত কঠিন ও বিপদজনক কাজ, তখন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের সাহসের পরিচয় দিয়ে অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। ক্ষমতা ও শক্তির দিক থেকে আগত বিপদ ও আতঙ্কের চোরা স্রোত হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিলে, তিনি আর যাই হোন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী নন।
সে কাঁপন ঠেকিয়ে বিভিন্ন দেশে কতজন কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ পথে নামতে পারেন? মিছিলে পা মেলাতে পারেন? বিবৃতি দিতে পারেন? কথায় বা লেখায় প্রতিবাদ করতে পারেন? এমন সাহসী ও সক্রিয় বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা সর্বদাই খুব কম। তুলনায় ভেকধারী বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাই বেশি।
ফলে ‘বুদ্ধিজীবী মানেই দায়বদ্ধ’ ভেবে নিয়ে গণহারে তাদেরকে সমাজের মুখপাত্র ভাবলে গুলিয়ে যায় সব। কে মানুষের পক্ষে আর কে পক্ষে নন, সেই বিচার-বিবেচনা করেই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী শনাক্ত করতে হয়। নচেৎ ব্যক্তিস্বার্থ ও দলের রাজনৈতিক মতলব হাসিলে তৎপর চাটুকারকেও ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে ভ্রম করার সমূহ আশঙ্কা থেকেই যাবে।
প্রকৃত বুদ্ধিজীবী যুক্তিবাদী সমাজের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই ছিলেন, যাদের আরেকটি নাম হলো ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’। তাদের ছিল ক্ষমতা, অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করার ঐতিহ্য। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল সেই ঐতিহ্যের সাহসী পথ নির্মাণ করে গিয়েছেন।
প্রকৃত বুদ্ধিজীবী বা পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল-এর বিপরীতে প্রাচীনকাল থেকেই একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর রাজানুগ্রহের ইতিহাসও সুপ্রাচীন।
রাজদরবারের ‘ভাঁড়’ বা রাজার মনোরঞ্জনে পারদর্শী ব্যক্তিগণও এক অর্থে বুদ্ধিজীবি। ভাঁড় শব্দের অর্থ হলো বিদূষক, যারা হালকা ঠাট্টা পরিহাস করে লোককে খুশি করতে পারঙ্গম। রাজরাজড়াদের মতো স্পর্শকাতর, মেজাজি, ক্ষমতামত্ত মানুষকে বিনোদন দেওয়া ও খুশি করাও একটি কঠিন কাজ। এসব করতে বুদ্ধি খাটাতে হয়। কৌশল জানতে হয়। যারা এসব জানেন, তারা দরবারের এককোণে জায়গা পান। কখনও রাজা খোশ হলে ইনাম ও তোহফা পান। একসময় তারা বুদ্ধিমান লোক বলে স্বীকৃত হন এবং কালক্রমে বুদ্ধিজীবী বনে যান।
প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব যেখানে দলমত নির্বিশেষে দায়িত্বশীল বা ক্ষমতাবানদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া, ভাঁড়ের কাজ সেখানে মনোরঞ্জন ও চাটুকারিতা করা। বস্তুতপক্ষে, সভ্যতার ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে উভয় শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। কৃতকর্মের নিরিখে সমাজে ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের স্ব-স্ব আসন ও অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে। সবসময়ই দেখা গেছে যে, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী সমালোচনামূলক হওয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন আর ভাঁড় বুদ্ধিজীবী তৈলমর্দন ও তোষামোদপূর্ণ আচরণের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও বাহবা লাভ করেন। কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ প্রকৃতের ভাগ্যে জোটেছে আঘাত আর ভাঁড় পেয়েছে পদ-পদবি পুরস্কার।
অতএব, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী আর দরবারের ভাঁড় শ্রেণির বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই রয়েছেন। মুস্কিল হলো, অনেক সময়ই তাদেরকে আলাদা করা যায় না। তেল ও ঘি আলাদা করতে যেমন কিছু যোগ্যতা লাগে, প্রকৃত ও ভাঁড় বুদ্ধিজীবীর পার্থক্য করতেও তেমনি কিছু সাধারণ জ্ঞান থাকতে হয়। নইলে আম ভেবে আমড়া নিয়েই থাকতে হয়।
প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও স্পর্ধা। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকার দৃঢ়তা। এমন বুদ্ধিজীবী সংখ্যায় এতো কম যে, তাদেরকে প্রচারে বা বুদ্ধিজীবিসুলভ ভাব-ভঙ্গিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বুদ্ধিজীবী সেজে ঘুরে বেড়ানোর ফুসরতও তাঁদের নেই। সরাসরি সরকারের দালালি কিংবা হাত ঘুরিয়ে ভাত খাওয়ার মতো পরোক্ষ তাবেদারি করতেও তাঁরা নারাজ।
তাঁদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় বিপরীত স্রোতে, জনতার পক্ষে এবং বিকল্প চিন্তা ও তৎপরতায়, যা ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতা-প্রত্যাশী, কারো কাছেই প্রশংসা ও বাহবা পায় না। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা-আকাক্ষীরা মূলত চায় যে, জনতা থেকে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত সবাই শুধুমাত্র তাদেরই সমর্থন করুক ও প্রশংসায় লিপ্ত থাকুক। তারা চায় দলীয়ভাবে অনুগত বুদ্ধিজীবী। প্রকারান্তরে যা আসলে ভাঁড়। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর জায়গা সে কারণেই ক্ষমতার বড় বা ছোট বৃত্তে হয় না।
ইতিহাসের কঠিন পরিস্থিতিতে প্রমিথিউসের মতো দেখতে পাওয়া যায় প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের। যখন কেউ কথা বলে না, তখন সোচ্চার হন তাঁরা। পুরো পরিস্থিতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষ ও সত্যের পক্ষাবলম্বন করেন যেসব বুদ্ধিজীবী, ইতিহাস তাঁদেরকে ভাঁড় সম্প্রদায়ের চেয়ে আলাদা করে এবং প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দেয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ পাকিস্তানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম নির্যাতনের সম্মুখীন এবং বাঙালি জাতি গণহত্যার শিকার, তখন পাকিস্তানের প্রায়-সবাই জান্তার অপকর্মের পক্ষে অবস্থান নেয়। তখন শুধুমাত্র পাকিস্তানের দু’এক জন বুদ্ধিজীবীর প্রতিবাদের কথা জানা যায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও তাঁরা পথে নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন।
এটা ঠিক যে, প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরেও পাকিস্তানে মানবাধিকার মোটেই সুলভ বস্তু নয়। আর ১৯৭১ সালে তো পাকিস্তানে কঠোর সামরিক শাসন চলছিল। যারা তখন পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের নীতি ও তৎপরতার সমালোচনা করে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সংখ্যায় অতি সামান্য হলেও তাঁরা জীবনের কতটা ঝুঁকি নিয়ে সে কাজ করেছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়।
একজন ছিলেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। সকল স্বপ্ন চুরমার করে পাকিস্তান পাকাপাকি ভাবে একটা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হলে তিনি ১৯৪৭ সালে দেশটির স্বাধীনতার কয়েক বছর বাদেই প্রতিবাদ করায় শাসকের দৃষ্টিতে দেশদ্রোহিতার অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ হন। তিনিই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখলেন ‘হজর করো মেরে তনসে’ নামের ঐতিহাসিক প্রতিবাদী কবিতা। তীব্র ঘৃণায় তাঁর প্রতিবাদ ঠিকরে উঠেছিল, “সাজতেই যদি হয় কী করে সাজবে বলো তো, গণহত্যার এই মেলা/ বলো তো প্রলোভিত করবে কাকে আমার রক্তের এই আর্তনাদ।”
আরেকজন, ঢাকাতে শৈশব ও প্রথম যৌবন কাটানো কবি আফজ়ল আহমেদ সৈয়দ, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানের মাটিতে বসেই লিখলেন এক সাধারণ বাংলাদেশি মেয়ের কথা। “তার দরিদ্র দেশ/ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে/ সে দুনিয়ার সব্বাইকার/ থেকে বেশি স্বাধীন এবং বেশি খুশি।”
প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হওয়া, বিরূপ অবস্থায় মানুষ ও সত্যের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করা সহজ কথা নয়। সকলের পক্ষে এমন অবস্থান নেওয়া সহজ নয়, সম্ভবও নয়। উপমহাদেশ জুড়ে এতো বড় কবি নামে প্রসিদ্ধ মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবও সঙ্কুল পরিস্থিতিতে অটল থাকতে পারেন নি। ইংরেজদের হাতে ভাইয়ের মৃত্যু, লাঞ্ছনা, মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেও ‘দস্তম্বু’ নামের আত্মজীবনীতে শুধু ইংরেজ সরকার নয়, সৈন্যদেরও প্রশংসা করেন তিনি। মহারানি ভিক্টোরিয়ার উপর দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক কাসিদা লিখে বই সমাপ্ত করেন এই কবি।
শুধু গালিব নন, শাসককে মুচলেকা দেওয়া, ক্ষমতার দালালি করা, অন্যায়ের পক্ষ নেওয়া বহু লোকই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমাজে বীরদর্পে দাপট দেখায়। ভাঁড়ামি ও ভণ্ডামি দ্বারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত লোকজনও বুদ্ধিজীবীর তকমা লাগিয়ে মানুষকে জ্ঞানদান করে। এভাবেই, দায়বদ্ধ, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর অবর্তমানে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে বুদ্ধি বিক্রেতারা সমাজের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক-বিশ্লেষক।