ধ্বংসস্তূপের ভয়ার্ত জমিনে যেভাবে রানের ফুল ফোটালেন, সন্ধ্যায় তারই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিটন কুমার দাস কি গুনগুনিয়ে ছিলেন– ‘ফুল ফুটেছে, গন্ধে সারা মন।’ না, উদাস হয়েছিলেন বিভোর লাগা গোধূলিলগ্নে। চাপা স্বভাবের মৃদুভাষী লিটন নিশ্চয়ই কাল মিষ্টি করে হেসেছিলেন; সেঞ্চুরির পর হেলমেটে চুমু খেয়ে যেমন স্মিত হেসেছিলেন ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরে। এ রকম হাসির উপলক্ষ তো আর সব সময় আসে না।
লিটন টেস্টের প্রতি ম্যাচে সেঞ্চুরিও করেন না। ৪৩তম টেস্টে তৃতীয় আর বিদেশের মাটিতে প্রথম সেঞ্চুরি করা আনন্দে ভাসার মতোই। তাও বিপর্যস্ত ইনিংস মেরামত করে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিয়ে কষ্টার্জিত শতক। ধ্বংস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মত মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে গড়েছেন রেকর্ড জুটি। ২৬ রানে ছয় উইকেট হারানো দলকে পৌঁছে দিয়েছেন ২৬২ রানে। সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, প্রতিপক্ষের লিড ১২ রানে নামিয়ে আনতে পারাতেই মিলেছে রাজ্যের খুশি।
বিনা উইকেটে ১০ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে তৃতীয় দিন দারুণ শুরুর স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ। এই সুখ সকাল সকাল শোকে রূপ নেবে– কে জানত? খুররম শাহজাদের বোলিং ব্যাটিং লাইনআপ তছনছ করে দিলে ড্রেসিংরুমে নেমে এসেছিল অন্ধকার। লিটন-মিরাজ ছিলেন শেষ ভরসা। তারাই একটু একটু করে বিপর্যস্ত ইনিংস মেরামত করেন। সেই মুহূর্ত নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হলে লিটন বলেন, ‘কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। কারণ, আমি ভাবতেই পারিনি পানি পানের বিরতির আগে ব্যাট করতে হবে। তাই নার্ভাস ছিলাম। মিরাজকে বলেছিলাম, এ মুহূর্তে খুব ভালো ছন্দে আছে তারা (পাকিস্তান)। আমরা সময় নিয়ে ইনিংস লম্বার করার চেষ্টা করব।’
২৬ রানে ছয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পর লিটন-মিরাজের ১৬৫ রানের জুটি টেস্ট ইতিহাসেই প্রথম। আবার ৩০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারিয়ে আট নম্বরে নেমে টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ইনিংস মিরাজের ৭৮ রান। সবচেয়ে বড় কথা, টানা তিন ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি করা মিরাজের ধারাবাহিকতা প্রকাশ পায়।
পাকিস্তানের বিপক্ষেই ছিল লিটনের অভিষেক সেঞ্চুরি। ২০২১ সালে চট্টগ্রামে ১১৪ রান করেছিলেন। পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৪১ রান ঘরের মাঠে। তৃতীয় সেঞ্চুরি বিদেশের মাটিতে সদ্যপ্রাপ্ত। পরিস্থিতি এবং খেলার ধরন মিলিয়ে পাকিস্তানের এক সাংবাদিকের কাছে মনে হয়েছিল, এটিই বোধ হয় লিটনের সেরা। সেখানে লিটনের উত্তর ছিল, ‘আমি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৪১ রান করেছিলাম অনুরূপ প্রতিকূলতায় থেকে। আমি মনে করি, ওটা ভালো সংগ্রহ। তবে আমার ভাগ্য ভালো, এখানে রান পেয়েছি। আমি খুশি দলের সংগ্রহ বড় করতে পেরে।’
মিরাজের আউটের মুহূর্তেও ঝুঁকিতে ছিল বাংলাদেশ; ৮ উইকেটে ১৯৩ রান। লিটনের আসল সংগ্রামটা মিরাজের আউটের পরই। পেসার হাসান মাহমুদকে নিয়ে ইনিংস টেনে নেওয়ার সে চ্যালেঞ্জেও জয়ী হলেন। লিটন বলেছিলেন রোমাঞ্চকর সে জুটির কথা, ‘হাসান যখন আসে, আমি তখন রক্ষণাত্মক মাইন্ড সেটে চলে গিয়েছিলাম। কারণ, আমি স্ট্রাইকে গেলে সব ফিল্ডার বাউন্ডারিতে থেকেছে। আমার কোনো সুযোগই ছিল না বাউন্ডারি হাঁকানোর। হাসানকে কৃতিত্ব দিতে হবে, সে আমাকে অনেকক্ষণ খেলার সুযোগ দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি– যতক্ষণ আমরা উইকেটে থাকব এক-দুই রান করে এগোব। আর যতটা এগোব, তাতে প্রতিপক্ষের লিডের পরিমাণটা কমবে।’ লিটন যেন তাঁর নামের সার্থকতা দিলেন। যার নামের অর্থ বিজয়ী, তিনি তো জয় করবেনই।
samakal