ব্যালটের বোবা কান্না

Daily Nayadiganta


ভাত ও ভোটের দাবিতে অর্থাৎ সম্পদের সুষম বণ্টন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এ দাবি দু’টি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সম্পদের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে ধনীরা দিন দিন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। মধ্যবিত্তরা হচ্ছেন দরিদ্র। আর দরিদ্র হচ্ছেন হতদরিদ্র। যার ২০০ বিঘা জমি ছিল তিনি হাজার বিঘা জমির মালিক বনে গেছেন। যিনি ছিলেন ১০ বিঘা জমির মালিক, তিনি অভাবের তাড়নায় জমিজমা বিক্রি করে হয়েছেন হতদরিদ্র। সপরিবারে স্থান হয়েছে বস্তিতে। ভোটের অধিকার হয়েছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনী সংস্কৃতিতে’। অর্থাৎ নির্বাচন নামের একটি আনুষ্ঠানিকতা থাকবে, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না। এতে জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়ে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যালট বাক্স ব্যালটে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

সংবিধান মোতাবেক জাতীয় ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে পরিচালিত হওয়ার বিধিবদ্ধ নিয়ম থাকলেও বর্তমান সরকারের আমলে ‘নির্বাচন’ নামক পদ্ধতি প্রায় নির্বাসিত। ‘নির্বাচন’ শব্দটির জায়গা এখন শুধু পত্রিকার পাতায়, আমলাদের প্রতিবেদনে এবং নির্বাচন কমিশনারের মুখে মুখে। অর্থাৎ কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। ক্ষমতার বদৌলতে ব্যালটকে যে যেভাবে খুশী ব্যবহার করছেন। ব্যালটের মালিক ‘জনগণ’ এখন বনবাসে রূপবানের মতো, কারণ ভোটারের ব্যালটকে কোথায় কে প্রয়োগ করেছেন জনগণ তা জানতে পারেন না। ভোটারের ব্যালটটি কে কখন লুটে নিচ্ছেন তার কোনো হদিস নেই। অন্য দিকে ব্যালট লুট দেখতে দেখতে জনগণ হয়রান বিধায় এখন আর তারা খোঁজখবর নেয়ার গরজবোধ করেন না। বরং নির্বাচনের দিন সুখের ঘুমা ঘুমাতেই বেশি স্ব^াচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা। বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বাচনের জয়লাভে এখন আর জনগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না, শুধু প্রয়োজন একটি ‘নমিনেশন’ এবং রেডিও, টিভিতে একটি অ্যানাউন্সমেন্ট। ফলে জনগণকে নির্বাচনে ব্যালট ব্যবহারের স্বাদ ঘরে বসে টেলিভিশন দেখে দেখেই মেটাতে হয়। ব্যালটের মালিক অর্থাৎ জনগণের এ অবস্থা দেখে মুখ লুকানো ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর থাকে না তাদের।

ব্যালটের প্রয়োগগত ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছে। জনগণের দাবির মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতির স্থান সংবিধানে সংযোজিত হওয়ার পর ব্যালটের মান মর্যাদা কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিল, কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্যালট ফের নির্বাচনী লুটেরাদের হাতে অপব্যবহার হতে হতে বর্তমানে নির্বচনী ব্যবস্থায়ই নির্বাসনে গেছে।

নির্বাচনীব্যবস্থা শুধু স্থানীয় শাসন ও জাতীয় পর্যায়ে ভূলুণ্ঠিত হয়নি, বরং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ ব্যবস্থা অনুপ্রবেশ করেছে। গ্রাম ও মফস্বল শহরের সব প্রতিষ্ঠান হাট-বাজারসহ সব কমিটিতে এখন নির্বাচন পদ্ধতি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। স্থানীয়পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যেকের সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে। সরকারদলীয় নেতা যাকে সিলেকশন দেবেন; তিনিই হবে সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের স্বঘোষিত ‘নির্বাচিত’ কর্মকর্তা। সংসদ সদস্যদের বাহিনী এখন শহর-বন্দর, মহল্লা-অলিগলি সর্বত্রই নিয়ন্ত্রণ করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে বা রুখে দাঁড়ালেই তার কপালে রয়েছে কারাবরণ অথবা শারীরিক নির্যাতন।

ব্যতিক্রম শুধু আইনজীবী সংগঠনের নির্বাচন। জেলাপর্যায়ে আইনজীবী সমিতিগুলোতে কোথাও কোথাও সরকারি প্রভাবের কথা শোনা গেলেও ৯০ শতাংশ আইনজীবী সমিতিতে সদস্যরা লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন প্রতি বছর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয় খুবই উৎসবমুখর পরিবেশে। ২০২১-২২ সেশনের কার্যকরী পরিষদ নির্বাচনে সভাপতি পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবদুল মতিন খসরু ৮৩৬ ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদ শূন্য হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে ঢাকা হাইকোর্ট আইনজীবী সমিতি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে গঠিত হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। নির্বাচিত হয়েই মৃত্যুবরণ করায় পূর্ব ইতিহাস অত্র সমিতিতে কোনো নজির নেই। ফলে শূন্য পদে সভাপতি হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করবেন, গত মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বৈঠকে গোলযোগের মাধ্য দিয়ে শেষ হয়। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। সরকারি দলের দাবি- সদ্য বিদায়ী সভাপতিই সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ইতঃপূর্বে তিনি সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছেন। বিরোধী দলের দাবি- ব্যালটে নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত করতে হবে। কোন দাবিটি যুক্তিসঙ্গত তা অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের সদস্যরা বিবেচনা করবেন।

ব্যালট ব্যবহারের সংস্কৃতি দিন দিন কমে আসছে। ফলে ব্যালটের মালিকদের পাশ কাটিয়েই গদিতে বসার স্বাদ এখন গতানুগতিক হওয়ায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ সংস্কৃতি দিন দিন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই সংস্কৃতি এখন যেন জনগণের গা সওয়া হয়ে গেছে; ফলে ‘অধিকাংশের বিবেক’ এখন আর কাজ করছে বলে মনে হয় না।
লেখক : রাজনীতিক ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)

[email protected]