ব্যাংক খাত টেনে তোলার পরামর্শ আইএমএফের

দুর্বল অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে টেনে তুলতে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, সরকারের উচিত হবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যথাযথ কৌশল তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা।

আইএমএফ আরও বলেছে, টেকসই আর্থিক খাত তৈরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে চলমান ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থার কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি দরকার করপোরেট সুশাসনের উন্নয়ন ও আইনি কাঠামোর সংস্কার।

আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি রয়েছে। এ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পাওয়ার কথা চলতি মাসেই। এর আগে দুই সপ্তাহের জন্য ঢাকায় এসে আইএমএফের দল ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যালোচনা বৈঠক শুরু করে গত ২৪ এপ্রিল। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে গতকাল তা শেষ করে আইএমএফ।

এরপর গতকালই সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশকে বাণিজ্য বহুমুখীকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে, ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নয়ন ও সুশাসনে জোর দিতে হবে।

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের কর-জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) হার নিম্নতম। কর সংগ্রহে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। কর বেশি সংগ্রহ করতে পারলেই তা সামাজিক কল্যাণে ব্যয় করা সম্ভব হবে এবং উন্নয়নমূলক কাজেও বেশি করে হাত দেওয়া যাবে। জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর-রাজস্ব যাতে বাড়ে, আগামী বাজেটে সে জন্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

আইএমএফ গত মাসে বলেছিল, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। গতকাল সংস্থাটি তা কমিয়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশের কথা বলেছে। যুক্তি হিসেবে আমদানি সংকোচনের কথা উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। তবে এ–ও বলেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে টেকসই হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপও কমে আসবে। বাড়বে আমদানি।

ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়ার কারণে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। সুদের হার বেশি হওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি বেশি—এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।’

ব্যাংকের একীভূতকরণ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের দরকার আছে। কারণ, বাংলাদেশে যে ৬১টি ব্যাংক আছে, তার মধ্যে কিছু খুবই সবল, আবার কিছু সবল নয়।

বাংলাদেশ মাসে মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা চালু করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফের দলটি। ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘সরকার এ ব্যাপারে কাঠামোগত সংস্কার করেছে। বিনিময় হারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগকেও আমরা স্বাগত জানাই। সুদের হারও যত দূর সম্ভব নমনীয়। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আরও বজায় থাকলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মানি লন্ডারিং নিয়ে আইএমএফ কখনো কোনো কথা বলে না। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, আইএফএফের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে, অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ। যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়, তার মধ্যেই কিন্তু অর্থ পাচার রোধের সমাধানের কথা বলা আছে।

রিজার্ভের শর্ত শিথিল

এদিকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের দেওয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ১১ কোটি মার্কিন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা ৫৩৬ কোটি ডলার কমিয়ে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলারে নামিয়েছে সংস্থাটি।

রিজার্ভ সংরক্ষণে ১৬ মাসে কয়েক দফা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আইএমএফের বৈঠকে রিজার্ভের লক্ষ্য কমানোর সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। এর আগেও রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। তখন সরকারের অনুরোধে আইএমএফ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ১১ মাসে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিক্রি করার নীতি চালু রাখা হলে রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্ত বাংলাদেশ কোনো দিনই পূরণ করতে পারবে না। বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করে আগে ওই নীতি থেকে সরতে হবে।

prothom alo