ব্যাংক ঋণের সুদহার আরো বাড়ল

দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলে আবারো নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আজ থেকে রেপো রেট হবে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর আগে গত ৪ অক্টোবর এক ধাক্কায় রেপো রেট ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছিল। সে হিসাবে মাত্র দুই মাসের মধ্যেই রেপো রেট ১ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ল। রেপো রেট বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোরও ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গতকাল সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারীকৃত এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নীতি সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সঙ্গে প্রযোজ্য বিদ্যমান মার্জিন আরো ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। আজ থেকে এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

নীতি সুদহারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো টাকা ধার নেয়। সুদহার বাড়ানোয় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরো বেশি সুদে অর্থ ধার করতে হবে। এর প্রভাব দেশের সরকারি-বেসরকারি সব খাতের ওপর পড়বে। দেশের ব্যাংকগুলো ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও বাড়াবে। বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রেপো রেট বাড়ানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই মূল্যস্ফীতির এ হার ৮ শতাংশ এবং ২০২৪ সালের জুনে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই নীতি সুদহারসহ ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দাবি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুসৃত সংকোচনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা হবে।

ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত পূরণ করতে গিয়ে চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৯ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেয়া হয়। এখন প্রতি মাসের শুরুতে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট রেট ঘোষণা করা হচ্ছে। চলতি নভেম্বরের জন্য ঘোষিত স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলো এখন ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারবে। তাতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেড়ে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ হবে।

নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানাতে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প দেখছি না। ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে মানুষ আগের চেয়ে কম ঋণ নেবে। আবার যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তারা বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংকে টাকা রাখবে। এতে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আমরা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামাতে চাই। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনে আবারো সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল আসতে কিছুটা সময় লাগে। বৈরী আবহাওয়া অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে বাধাগ্রস্ত করে। আগেও আমরা বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু বর্ষাকাল হওয়ার কারণে ভালো ফল পাওয়া যায়নি। এখন আবহাওয়াজনিত কোনো সমস্যা নেই। তাই আশা করছি খুব দ্রুতই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।’

ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, এ মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই মূল লক্ষ্য। প্রয়োজনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হবে। তার পরও সবার আগে মূল সমস্যায় নজর দিতে হবে। এরই মধ্যে ক্ষুদ্র ও কৃষি ঋণ বিতরণের গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। পদ্মা সেতু, বিভিন্ন রেল ও সড়ক পথের উন্নয়নের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান সহজ হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ২২ নভেম্বর পুনর্গঠিত মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অর্থনীতিবিদ ড. সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিনসহ কমিটির সদস্যরা অংশ নেন। ওই সভার সুপারিশ অনুযায়ী নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকেই দেশের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আগস্টে মূল্যস্ফীতির এ হার ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার এক ধাক্কায় দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও অক্টোবর শেষে দেখা গেছে, এ মাসে মূল্যস্ফীতির হার না কমে উল্টো আরো বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানোর জন্য নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। যদিও বাজারে বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। সুদহার বেশি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দৈনিক ধারের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। গত ২৫ অক্টোবর দেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ধার নেয় ব্যাংকগুলো। ওই দিন ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। এরপর প্রতিদিন নেয়া ধারের পরিমাণ ১৫-২০ হাজার কোটি টাকায় ওঠানামা করছে। ২২ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা।

প্রথাগত মুদ্রানীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় সুদহারসহ অর্থনীতির সব কাঠামোই বাজারভিত্তিক। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি প্রায় শতভাগ ব্যাংকনির্ভর। আমাদের অর্থনীতির এখনো অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের আওতার বাইরে। বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটগুলোর মূলে অব্যবস্থাপনা, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, সুশাসনের ঘাটতিসহ বহুবিধ কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না। মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির সংকট কাটাতে হলে দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার লাগবে।’

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অর্থনীতির অন্যসব উপাদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ এ দেশে কার্যকর হবে না। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমানোর যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তাতে এসএমই, কৃষিসহ উৎপাদনশীল খাতই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেসব প্রভাবশালী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নিচ্ছেন, তাদের ওপর মুদ্রানীতির কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং বাজারে পণ্যের সরবরাহ লাইন যাতে ভেঙে না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতগুলোয় অর্থের প্রবাহ নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনে প্রণোদনা দিতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তাতে মূল্যস্ফীতি আরো উসকে উঠবে।’

বনিক বার্তা